মধ্যেপ্রাচ্যে গত এক বছরে বিপদের অনেক মুহূর্ত এসেছে, তবে এই সময় সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। গত সাত দিনে ইসরায়েল হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে, লেবাননে স্থল আক্রমণ শুরু করেছে এবং ইরান ইসরায়েলজুড়ে লক্ষ্যবস্তুতে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ১০ মিলিয়ন ইসরায়েলিকে সারা দেশে বোমা আতঙ্কে আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে।দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে বর্তমানে।

 

এ ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ তার মিত্ররা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। যা সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি লক্ষণ। আইডিএফ বলেছে, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়। তবে অল্প সংখ্যক ইসরায়েলের মধ্য ও দক্ষিণে আঘাত করেছিল।

এতে অধিকৃত পশ্চিম তীরে একমাত্র ফিলিস্তিনি ব্যক্তি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো এ অঞ্চলে উত্তেজনা কমানোর ওপর জোর দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ শত্রুতা অবিলম্বে সমাপ্তির জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলকে সমর্থন জানালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানিসহ জি-৭-এর দেশগুলো সব পক্ষকে সংযম করার আহ্বান জানিয়েছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থই হয়েছে, বরং আগের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য সর্বাত্মক যুদ্ধের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।

 

দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, লেবাননের ভূখণ্ডে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে।এর মধ্যে ২৬১ জন নারী ও ১২৭টি শিশু রয়েছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩৭ জন নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা ১৫১।

শুক্রবার সন্ধ্যা: নাসরুল্লাহকে হত্যা

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির দক্ষিণ শহর একের পর একে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রচন্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে।

বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে আঘাত হানে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো, মাটিতে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে। লেবাননের রাজধানীজুড়ে দৃশ্যমান হয়ে পড়ে থাকে ধুলো এবং কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ।

 

এর আগে ভূগর্ভস্থ একটি বাঙ্কার লক্ষ্য করে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে নিহত হন। ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করতে পারে, এই ভয়ে নাসরাল্লাহকে বহু বছর ধরে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। হিজবুল্লাহর এই নেতাকে হত্যার জন্য ইসরায়েলি সেই হামলার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে এবং ওই হামলায় মৃত্যু হয় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের। নাসরাল্লাহর মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমার সকল আশা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

এরও এক সপ্তাহ আগে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর জন্য তৈরি ওয়াকিটকি এবং পেজার বিস্ফোরণের একটি সিরিজে কমপক্ষে ৩২ জন নিহত এবং ৩ হাজারের বেশি মানিুষ আহত হয়েছিল। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য একটি মার্কিন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তা আর আশার আলো দেখেনি।

সোমবার রাত: ইসরাইলের লেবানন আক্রমণ

৩০ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননে প্রবেশ করে এবং স্থল আক্রমণ শুরু। এ বিষয়ে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) বলেছে, তাদের অভিযান হবে ‘সীমিত এবং কিছু লক্ষ্যবস্তুতে’। লেবাননের ক্রাইসিস ইউনিটের মতে, যুদ্ধ এখন পর্যন্ত প্রায় ১.২ মিলিয়ন মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে। এই অভিযানে অন্তত ৮ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে।

ইসরায়েল বলেছে, অপারেশনটি লক্ষ্য হিজবুল্লাহ যেনো সীমান্তে রকেট এবং ড্রোন হামলা বন্ধ করে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দিকে গোলা ছুড়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলি সেনারা একই সঙ্গে দুটি ফ্রন্টে স্থল যুদ্ধ শুরু করেছে। গাজা এবং লেবানন, যা কয়েক দশকে ঘটেনি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা: ইরানের ইসরায়েল আক্রমণ

এর পরের দিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ইরান ইসরায়েলে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ওই হামলায় ১০ মিলিয়ন ইসরায়েলি আশ্রয়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এরপর থেকে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে।

এর আগে ২০০৬ সালে ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে শেষ যুদ্ধ হয়। জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৭০১- এর মাধ্যমে তা অনিশ্চিতভাবে শেষ হয়েছিল। হিজবুল্লাহ তখন দক্ষিণ লেবানন থেকে তার বাহিনী সরিয়ে ফেলে। এদিকে লেবানন সীমান্তের ব্লু লাইন থেকে কিছু শান্তিরক্ষী সরিয়ে নিতে ইসরায়েলি অনুরোধ নাকচ করেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন ইউনাইটেড নেশনস ইন্টেরিম ফোর্স ইন লেবানন (ইউএনআইএফআইএল) ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সীমান্ত থেকে শান্তিরক্ষীদের সরিয়ে নিতে অনুরোধ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বিষয়ক সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে লাক্রোয়া।

লাক্রোয়ার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘ আগে থেকেই লেবাননের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের স্থল অভিযান চালানোর সম্ভাবনা অনুমান করেছিল। তাই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তারা।

ব্লু লাইন হল জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া একটি লাইন যা লেবাননকে ইসরায়েল ও ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমি থেকে পৃথক করেছে। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে চলে যাওয়া ইসরায়েলি বাহিনী ব্লু লাইনের অপর পাশে অবস্থান নেয়। যেকোনও পক্ষ থেকে অনুমোদনবিহীনভাবে স্থল বা আকাশপথে ব্লু লাইন পার হলে তাকে নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ প্রস্তাবের লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। দুই রাষ্ট্রকে বিভক্তকারী ব্লু লাইন বরাবর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি দেশের সেনাবাহিনী থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের আনা হয়েছিল। ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননের আক্রমণ করার পর ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের মোতায়েন করা হয়।

এই শান্তিরক্ষী বাহিনীটি ‘ইউএন ইন্টেরিম ফোর্স ইন লেবানন’ বা ইউএনআইএফআইএল নামে পরিচিত। প্রতি বছর জাতিসংঘের ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ বাহিনীটির দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করে দেয়।
 

এরপর কি?

হিজবুল্লাহর বিধ্বংসী ক্ষতি সত্ত্বেও, তারা লেবাননে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছে। ইতিহাস বলছে, ইসরায়েলের পক্ষে লেবাননে প্রবেশ করা সহজ, কিন্তু তাদের পক্ষে বের হয়ে আসা কঠিন।

ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মঙ্গলবার থেকে মধ্যপ্রাচ্য থমথমে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার অংশ হিসেবে তিনি ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক বা তেল স্থাপনায় হামলার বিষয়টি সমর্থন করেন না।

যদিও একটি গুরুতর জবাব অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে এবং নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি শেষ পর্যন্ত ইরানে শাসন পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। তবে ইসরায়েলের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য গাজায় ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ এবং উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করা।

ইসরায়েলি নেতারা উল্লেখ করেছেন, তারা অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে। নেতানিয়াহু বলেছেন তারা  যুদ্ধ করছে গাজা, লেবানন, পশ্চিম তীর, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে। যদিও ইরাক এবং সিরিয়ায় ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলো এখনও পর্যন্ত খুব কমই  হুমকি তৈরি করেছে।

সূত্র : বিবিসি