২১ মার্চ, শুক্রবার। কুইনসের আগ্রা পার্টি হল যেন হয়ে উঠেছিল বাংলা সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির মিলনমেলা। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা ও সিবিএন টিভির যৌথ আয়োজনে এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে মাতিয়েছিলেন নিউইয়র্কের কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই রাতটি ছিল আবেগ, শ্রদ্ধা আর সৃজনশীলতার এক অনবদ্য প্রতিচ্ছবি। ভিন্নতায় ভাবালুতায় নিউইয়র্কের জনসমাজে বরাবরের মতোই ভিন্নমাত্রার আনুষ্ঠান করেছে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।
সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী, নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল হক এবং সিনিয়র লেখক সাংবাদিক রহমান মাহবুব শুরুতেই সবাইকে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান।
উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা, যিনি প্রথম আলোর সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরীকে “সাংবাদিকতার পাশাপাশি কমিউনিটি গঠনের দক্ষ কারিগর” আখ্যা দেন। প্রবীণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসান তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, অন্য বাংলা পত্রিকাগুলো নিউইয়র্কে যা করতে পারেনি, প্রথম আলো তা করতে পেরেছে। একটি ঐক্যবোধ প্লাটফর্ম করেছে, যেখানে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সংবাদ পরিবেশনেও তাদের ভিন্নতা উল্লেখ করে প্রবীণ এ সম্পাদক প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
হিউম্যান কনন্সার্ন ইউ এস এ সম্পাদক মাসুম মাহবুব,মধ্যপ্রাচ্যের গাজায় বিপন্ন মানবতার প্রসঙ্গ উচ্চারণ করে মানবতার পক্ষে সহমর্মিতা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। নিউইয়র্ক সিটির হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রেস সেক্রেটারি লোরা ব্রান্টলি তাঁর চমৎকার বক্তৃতায় মানবাধিকার, নারীঅধিকারসহ নগর প্রশাসনের এসংক্রান্ত কর্মসুচী প্রথম আলো’র সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করার আশ্বাস প্রদান করেন।
এবিসিসিআই চেয়ারম্যান গিয়াস আহমেদের বক্তব্যে উঠে আসে প্রবাসে বাঙালি উদ্যোক্তাদের সাফল্যের গল্প। মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় গিয়াস আহমেদ প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সব কর্মীদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানান। নারী সংগঠক সালমা ফেরদৌস তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, প্রথম আলো যেন আমাদের নতুন প্রজন্মকে লক্ষ্য করে সংবাদ ও অভিমত প্রকাশ করে। এর ফলে আমাদের নতুন প্রজন্মের সাথে শেকড়ের সংযোগটি দৃঢ় হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রবীণ জনসংগঠক ও কমিউনিটি নেতা নাছির উদ্দিন খান পল বলেছেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সম্পাদক তাঁর আপনজন বলেই নয়, এ পত্রিকার সাথে জড়িত সকলের কাজকর্মের সাথে তিনি পরিচিত। নাছির উদ্দিন খান পলকে মঞ্চে স্বাগত জানান মোহাম্মদ আলী।
নিউজার্সির পেটার্সন থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন স্কুল বোর্ডের নির্বাচিত কমিশনার মোহাম্মদ রশিদ। তিনি তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে জানান নিজেও প্রথম আলোর নানা কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে আছেন। এ আনন্দযাত্রায় সংযুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন মোহাম্মদ রশিদ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ‘কবিতার একপাতা’র সম্পাদক কবি ফারুক ফয়সল আবেগময় বক্তৃতায় চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় গত এক দশকের যৌথ পথ চলার মাধ্যমে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ মাসিক আয়োজন ‘কবিতার এক পাতা’ নিয়ে কথা বলেন। এ পাতার নিয়মিত কবিদের মধ্যে কবি হোসাইন কবির, কবি রওশন হাসান,কবি মনিজা রহমান, কবি লায়লা ফারজানা, কবি জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, কবি শামস চৌধুরী রুশো এবং কবি ফারুক ফয়সল কাব্যে ও কথনে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখেন।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সাহিত্য বিভাগ নিয়ে কবিতা ও আলোচনা পর্ব শুরু করেন এইচ বি রিতা। সেখানে কবিতা পাঠ করেন, শরিফুজ্জামান পল, সুমন শামসুদ্দিন, আহমেদ সহুল, রাজিয়া নাজমী, নবনীতা দ্বিমিত্রা, স্বপন বিশ্বাস, মিয়া আছকির, শামস রুশো, আক্তার নাসিমা, কান্তা কাবির। বক্তব্য রাখেন মনিজা রহমান, শেলী জামান খান, রওশন হক, কুলসুম আক্তার সুমী, শামসুন ফৌজিয়া, সুরিত বড়ুয়া, রুপা খানম, সিমু আফরোজা। ‘টক অফ দ্য উইক’ নামের ফেসবুক ভিত্তিক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলেন, ফরিদা ইয়াসমীন, সোহানা নাজনীন ও রোকেয়া দীপা।
অন্যান্যের মধ্যে সাপ্তাহিক জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার, প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ, সাংবাদিক সাঈদ তারেক, ডিজিটাল ট্রাভেল এস্টোরিয়ার সিইও নজরুল ইসলাম, ল সোসাইটির সহসভাপতি মোহাম্মদ জুনেল, ঢাকা জেলা এসোসিয়েশনের সভাপতি দুলাল বেহেদু, আমেরিকা বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান, অ্যাংকর ট্রাভেলের সিইও মাইনউদ্দিন পিন্টু, সানমান গ্লোবাল এক্সপ্রেসের সিইও মাসুদ রানা তপন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ জসিম ভূঁইয়া, সমাজসেবক ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক, টাইম টিভি’র প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাশীদা আখতার, সাংবাদিক জলি আহমেদ, আরিফুর রহমান, কলি ফারুক, আসিফুর রহমান, সাইফুল আলম, সায়ান সিদ্দিক, জাকির হোসেন, আব্দুল কাইয়ুম, সানজিদা উর্মি, তাসনুবা আনাম, মাসুম আহমেদ, শিল্পী মরিয়ম মারিয়া, মুক্তি জহির, কাবির আহমেদ, নুরুল খান , সাংবাদিক প্রতীক রহমান, কণ্ঠশিল্পী রোজী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কবি কাজী জহির তাঁর বক্তৃতায় , প্রবাসে সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করে এ সংবাদপত্রটির সমৃদ্ধি কামনা করেন।
সাংবাদিক শামীম শাহেদ তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে পত্রিকাটির সাথে একসময় নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি কৌতুক শুনিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী অধ্যায় ছিল পাঁচ মায়ের সম্মাননা। রওশন হকের মা গুলশান আরা চৌধুরী, রোকেয়া দীপার মা হাসনা হেনা, মনজুরুল হকের শাশুড়ি রোকেয়া বেগম, এইচ বি রিতার মা আনোয়ারা বেগম এবং শেলী জামান খানের মা সাজেদা জামানকে সম্মাননা দেওয়া হয়। গুলশান আরা চৌধুরীর কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠেছিল এভাবে— “সন্তানেরা যখন ভালো কাজে জড়িত, তখন মায়ের বুক ফুলে ওঠে। আপনাদের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।” রোকেয়া বেগমের চোখে জল এসে বলেছিলেন, “মেয়েকে সুযোগ দিয়েছেন বলেই আজ আমিও এই মঞ্চে।” মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন। উপস্থিত সকল দর্শক শ্রোতাদের মাতৃ অভিব্যক্তিই উচ্চারিত হচ্ছিল তাদের আশীর্বাদমাখা কণ্ঠে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ দিক ছিল নারীদের প্রাধান্য। রওশন হক, রাজীয়া নাজমী, ফরিদা ইয়াসমীন, সোহানা নাজনীন ও রোকেয়া দীপার আলোচনায় উঠে এসেছিল নারীর আত্মবিকাশের চ্যালেঞ্জ ও জয়গাথা। শেলী জামান খান, রুপা খানম, সিমু আফরোজার মতো নেতৃত্বদানকারী নারীরা বক্তব্যে তুলে ধরেন সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী ও নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল হকের প্রতি কৃতজ্ঞতা— “তাদের আস্থাই আমাদের পথ চলার শক্তি।”
কথা বলেছেন, অনুষ্ঠান পরিচালনায় সহযোগিতা করেছেন ঢাকা জেলা এসোসিয়েশনের দুলাল বেহেদু থেকে শুরু করে সাংবাদিক জলি আহমেদ, সমাজসেবক ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক প্রমুখ।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি ছিল হৃদয়ের ডায়েরিতে লেখা এক অধ্যায়। যেখানে কবিতার পাতায় লেগেছিল মায়ের আশীর্বাদের গন্ধ, আলোচনায় মিলেছিল প্রবাসের স্বপ্ন-সংগ্রামের ছায়া। সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী ও নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল হক ও তাঁর টিমের প্রতি উপস্থিত সবাই জানিয়েছেন অভিনন্দন। বলেছেন, — “আপনাদের হাত ধরেই এই আলোকিত যাত্রা চলমান থাক।”
ইফতার,নৈশভোজ ও সম্পাদকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।