খবর প্রকাশিত: ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ০৮:২৬ এএম
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ২ লাখ সৈন্য পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভুলভাবে ধরেই নিয়েছিলেন, রুশ সৈন্যরা কয়েক দিনের মধ্যে রাজধানী কিয়েভে প্রবেশ করতে পারবেন এবং দেশটির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সৈন্যদের একের পর এক অপমানজনক পশ্চাদপসরণে একটা বিষয় পরিষ্কার— তার প্রাথমিক আক্রমণের পরিকল্পনা স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
এমনকি এখনও রাশিয়ার নেতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর ইউরোপে বৃহত্তম এই আক্রমণকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসাবে বর্ণনা করেন। পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধ না হলেও ইউক্রেনজুড়ে বেসামরিক লোকজনের ওপর বোমা মারা হয়েছে। এই যুদ্ধে এক কোটি ৩০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় বিদেশে শরণার্থী অথবা নিজ দেশে বাস্তচ্যুত হয়েছেন।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনকে ‘নিরস্ত্র ও নাৎসিমুক্ত’ করার লক্ষ্যে দেশটিতে সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দেন। ইউক্রেন দখল করা রাশিয়ার লক্ষ্য নয়, বলেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে রাশিয়া-সমর্থিত ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর দখলকৃত পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানানোর কয়েকদিন পর এই আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেন তিনি।
তিনি আট বছরের ইউক্রেনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা থেকে লোকজনকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও রাশিয়ার এই ধরনের দাবির বাস্তবে কোনও ভিত্তি নেই। তিনি ইউক্রেনে ন্যাটোর পদচিহ্ন রাখতে বাধা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করার আরেকটি উদ্দেশ্যের কথা বলেন তিনি।
ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন পুতিনের এজেন্ডায় থাকলেও এ নিয়ে তিনি কখনই উচ্চবাচ্চ্য করেননি। ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘শত্রু পক্ষ আমাকে এক নম্বর টার্গেট নির্ধারণ করেছে। দুই নম্বর টার্গেটে রয়েছে আমার পরিবার। তার উপদেষ্টার মতে— রুশ সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট ভবনে অন্তত দু’বার হামলার চেষ্টা করেছে।
ইউক্রেনীয় নাৎসিরা গণহত্যা চালাচ্ছেন বলে রাশিয়া যে দাবি করে তার ব্যাখ্যায় রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্তি বলেছে, নাৎসিমুক্তকরণ অনিবার্যভাবে ইউক্রেনীয়মুক্তকরণও— বাস্তবে আধুনিক ইউক্রেন রাষ্ট্রকে মুছে ফেলা।
গত কয়েক বছর ধরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে রাষ্ট্র হিসাবে অস্বীকার করে আসছেন। ২০২১ সালে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছিলেন, নবম শতাব্দীর শেষের দিকে রুশ এবং ইউক্রেনীয়রা ছিলেন একই জনগোষ্ঠীর মানুষ।
ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর এক মাস এবং কিয়েভ ও চেরনিহিভের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সৈন্যরা পিছু হটার পর পুতিনের প্রচার-প্রচারণায় যুদ্ধের লক্ষ্য নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। তখন এই যুদ্ধে তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে ‘দনবাসের মুক্তি।’ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের দুটি শিল্প অঞ্চলকে উল্লেখ করে নতুন এই লক্ষ্যের ব্যাপারে কথা বলতে দেখা যায় তাকে।
উত্তর-পূর্বে খারকিভ এবং দক্ষিণে খেরসন থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ সৈন্যরা। কিন্তু তার সেই লক্ষ্য অপরিবর্তিত থেকে যায়। তবে খারকিভ ও খেরসনে রুশ সৈন্যরা সামান্য সফলতাও পায়।
যুদ্ধক্ষেত্রের এসব ধাক্কার পর গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার নেতাকে ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ দখলে নেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। যদিও পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক বা দোনেৎস্ক, দক্ষিণের খেরসন বা জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের কোনোটিরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি তিনি।
দুর্বল হয়ে পড়া সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়ায় প্রথমবারের মতো সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা দেন। যদিও এই সৈন্য সমাবেশ ছিল আংশিক। তবে প্রায় ৩ লাখ সংরক্ষিত সৈন্য যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নাম লেখান।
প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার সক্রিয় সম্মুুখসারিতে এখন যুদ্ধ চলছে। আর সময়ের সাথে সাথে রাশিয়ার জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিজয়ের সম্ভাবনাকে অনেকটা বিরলও বলা যায়। ঝটিকা অভিযান বলতে যা বোঝানো হয়েছিল তা এখন দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে জিততেই হবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমা নেতারা। আর ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার বাস্তবসম্মত রাশিয়ান সম্ভাবনা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে।
গত ডিসেম্বের প্রেসিডেন্ট পুতিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, চলমান যুদ্ধ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে। পরবর্তীতে তিনি বলেন, সামরিক সংঘাতের উড়ন্ত চাকা ঘোরানো রাশিয়ার লক্ষ্য নয়। তবে এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে। যদিও এই মুহূর্তে তেমন কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না।
একদিন পর যুদ্ধের বর্ষপূর্তি। তার আগে তিনি রাশিয়ার ‘ঐতিহাসিক সীমান্ত’ রক্ষা এবং ‘দনবাস ও নোভোরোসিয়ায় শান্তিপূর্ণ জীবন পুনর্গঠনে’ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের দক্ষিণের অঞ্চলগুলোও তার প্রকল্পের অংশ, ঠিক পূর্বের মতো।