খবর প্রকাশিত: ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১১:৩৩ পিএম
নিউউইয়র্কে একজন সফল বাংলাদেশী ব্যবসায়ী। তার রয়েছে নানান ধরনের ব্যবসা। রয়েছে রেস্টুরেন্ট, একাধিক গ্রোসারী শপ, এবং কনভিনিয়েন স্টোর। অত্যন্ত পরিশ্রমী, কর্মঠ কয়েস দিনরাতই ব্যস্ত সময় কাটান তার ব্যবনা নিয়ে। তবে কোটিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্কে নিজেকে দাড় করানো এতোটা সহজ ছিলনা।
অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে তাকে। রাত দিন পরিশ্রম করেছেন। শিকার হয়েছেন নানা প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতার। সাফল্য অর্জনের পথে হাজারো চ্যালেঞ্জ এসেছে বারবার। কিন্তু কোন বাধাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
প্রতিটি সমস্যাকে রুপান্তরিত করেছেন সম্ভাবনায়। যখনই বিপদ এসেছে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি। সাহস আর দৃঢ় প্রত্যয়ে দিয়ে সবকিছু মোকাবেলা করেছেন হাসিমুখে। আর তার পথ ধরেই আজ তিনি একজন সফল মানুষ। সফল ব্যবসায়ী।
ছোটবেলা খুব ডানপিটে স্বভাবের মানুষ ছিলেন কয়েস। দুরন্তপনা আর অতিচাঞ্চল্য ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। তাই রক্ষনশীল পরিবারের কড়া শাসনের মধ্যেই কেটেছ শৈশব।
তার বড়ভাই তাকে নিউইয়র্কে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। কিন্ত পড়ায় তার মন বসেনি। তিনি হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী।
আমরা মানুষের সাফল্য দেখি। কিন্তু সাফল্যের পেছনের গল্পটা দেখিনা। বড় ব্যবসায়ী হওয়ার পেছনে রয়েছে বড় ত্যাগ। ধৈর্য্য আর নিরন্তন অধ্যাবসায়। সাফল্যের সেই গল্প তিনি বলেছেন প্রবাস নিউজকে। পাঠকদের হাতে তা তুলে ধরছেন কয়েস তার নিজের মুখে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
আমার জন্ম ১৯৬৪ সালে। দুপুর ঠিক বারোটায়। গ্রামের বাড়িতে। ফেঞ্চুগঞ্জের গোলাঘাটের নোয়াটিলায়। তখনকার দিনে বাড়িতেই জন্ম নিতো শিশুরা। হাসপাতালে যেতোনা কেউ। সবচেয়ে বড় কথা ওই সময় সিলেট ছাড়া কোন ডাক্তার ছিলনা। তেমন কোন হাসপাতাল ছিলোনা। আমরা ৭ ভাই ৫ বোন। তাদের সবার জন্ম বাড়িতেই। ভাইবোনদের আমি চার নম্বর। সবার মধ্যে ৮।
আমার পড়ালেখা ব্রাক্ষনগ্রাম প্রাইমারি স্কুল। হাইস্কুল কাসেম আলী হাইস্কুল। এসএসসি ৮৬ সালে। আমাদের ফ্যামিলিতে পড়া লেখার ব্যাপারে অনেক শক্ত নিয়ম ছিলো। ছিলো কড়া শাসন। বাড়ির শাসন কর্তা ছিলেন আমার দুই নম্বর ভাই। সালেহ ভাই। সালেহ আহমেদ। তিনি আমাদের ভাইবোনদের জন্য একটা দৈনন্দিন রুটিন করে দিয়েছিলেন। সকাল ৭টায় যেতে হতো মসজিদে। আরবি পড়া শেষ করে সোজা গোসল। তারপর স্কুলে। স্কুল ছুটি হবার পরই দুপুরের খাবার। তা শেষ হতে না হতেই প্রাইভেট টিউটর আসতো। যে কারনে ফুটবলে লাথি মারার সুযোগও পেতাম না। তখন একই স্কেজুয়েল। টিচার ৭টায় আসতেন।
আমাদের মুদি দোকানের ব্যবসা ছিলো। সালেহ ভাই-ই ব্যবসা চালাতেন। তিনি আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক বেশি কনশাস ছিলেন। খেলাধুলা করতে যাতে না যাই এজন্য দোকানে বসিয়ে রাখতেন। পড়ালেখা করতে চাইতাম না। দোকানের গুদামের মধ্যে টেবিল চেয়ার দিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল।
বাড়িতে আসার পরই আবার টিচার রেডি। খুব কড়া ছিল। এসএসসির পরীক্ষার পর তিনটি কলেজে একযোগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। ফেঞ্চুগঞ্জ ড্রিগ্রী কলেজ, সিলেট পলিটেকনিক্যাল ও সিলেট এমসি কলেজ। পরিবার চাইল আমি ফেঞ্চুগঞ্চ পড়ি। যাতে দুস্টুমি না করতে পারি। এতো কিছুর কারন আমি ছোট বেলা খুব দুষ্টুমি করতাম। খুব দুরন্ত ও চঞ্চল ছিলাম।
একদিন বাবা তার রুমে ডাকলেন। অনেকগুলো ভালো উপদেশ দিলেন। বললেন, এমন জীবন তুমি করিবে গঠন মরিলে কাদিবে হাসিবে ভুবন।
যোগ দিলাম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে
কে শোনে কার কথা। কলেজে ফাষ্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। সবাই ধরল ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে। আমি সম্মত হলাম না। কারন বাড়ি থেকে পারমিশন পেলাম না।
আমার নানা ডাঃ মিনহাজ উদ্দিন শওকত মিয়া নামে এক চাচাসহ সালেহ ভাইয়ের কাছে গেলেন। তাকে বোঝালেন। অনুমতি নিয়ে আসলেন। এরপর আমি কলেজ ছাত্র সংসদে এজিএস পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। সর্বোচ্চ ভোটে পাশ করেছিলাম। আমার প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন এতো ভোট তোমাকে কে দিল।
কড়া শাসনের মধ্যে থেকেও আমার কিন্তু পড়া লেখার প্রতি ঝোক ছিল না। ঝোক ছিল রাজনীতির প্রতি। ভাইদের এতো ভয় পেতাম যে এক টেবিলে বসে ভাত খেতাম না। ছাত্র সংসদে নির্বাচন করার অনুমতি দিলেও আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখা হতো।
কারন আমার পুরো সত্ত্বাজুড়ে ছিলো রাজনীতি। দিনে খুব ভদ্র ছেলের মতো থাকতাম। রাত এগারোটায় সিটকিনি খুলে বেরিয়ে পড়তাম।
গভীর রাত পর্যন্ত সময় কাটতো রাজনৈতিক সহকর্মীদের সহচার্যে। আমার এই আচরন পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য হলোনা। সবাই খুব বিরক্ত।
বাবার আল্টিমেটাম অতঃপর আমেরিকা পাঠানোর প্রস্তুতি
ফাইনালি আমাকে একটা আল্টিমেটাম দেয়া হলো। আব্বা আমাকে ১ সপ্তাহ সময় দিলেন। বললেন, তোমাকে আমি পড়ার জন্য আমেরিকা পাঠাতে চাই। ভিসা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে আমাকে ভিসা ইন্টারভিউ এর জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো। তখন মতিঝিল শাপলা চত্বরে ছিলো আমেরিকান এ্যামবাসি। সেখানে ইসলাম হোটেলে থাকতাম। স্টুডেন্ট ভিসার জন্য দাড়ালাম। আমার ভিসা হলো।
একটা ঘটনা বদলে দিলো আমার জীবন
ওই সময় স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী তুমুল আন্দোলন চলছিল। একজন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে আমি আন্দোলন সংগ্রামে খুব তৎপর ছিলাম। মিছিল মিটিং লেগেই থাকতো। হরতাল অবরোধ চলতো সমান তালে। একবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হলো। সিদ্ধান্ত হলো আমরা ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ বন্ধ করে দেবো। গভীর রাতে আমরা দলবল মিলে ট্রেন লাইনের স্লাব খুলে ফেললাম। ট্রেন দূর্ঘটনায় পতিত হলো। চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেলো। পত্রিকায় বিরাট শিরোনামে খবর ছাপা হলো। পুলিশে আমাকে ধরতে তল্লাশী চালালো। এ নিয়ে আব্বা এবং মেজভাই আমার ওপর মহা বিরক্ত।
ওই একটি ঘটনা আমার জীবনের বাক বদলে দিলো। আমাদের পরিবারে একটা রেওয়াজ ছিল অন্যায় কিছু করা হলেই আপনি পিটুনি খাবেন। আমাকেও ওই ঘটনার জন্য বেদম পিটুনি দেয়া হলো। বলা হলো আজই তোমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। বেরিয়ে পড়ো।
আমার ভাগিনা আবদুশ শহীদ লন্ডন থাকত। সে ওই সময় বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো। বাড়িতে পুলিশের হানা দেয়ার আগেই আমি একটা সাইড ব্যাগে প্যান্ট শার্টসহ হাওর দিয়ে হেটে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে বালাগঞ্জ চলে গেলাম।
সেখানে পৌচ্ছে একটি মসজিদের চাপকলের পানিতে হাত পা ধুয়ে প্যান্ট শার্ট পরে নিলাম। বালাগঞ্জে ১ দিন থাকলাম। পরদিন আমার ভাগিনা নিয়ে আমাকে এয়ারপোর্ট ঢুকিয়ে দিয়ে আসলো। আমেরিকা আসার সময় লোকমান হোসেন লুকুও আমার সঙ্গী ছিল।
আসার পথে আমি একরাত হলান্ডে থাকি। সেটা আমার ট্রানজিট পয়েন্ট ছিলো।
ভেবেছিলাম আমেরিকায় টাকার গাছ আছে
১৯৮৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমি আমেরিকা ঢুকি। আমার বড় ভাই জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে পিকআপ করলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখি শুধু সাদা আর সাদা। অর্থাৎ স্নো পড়েছে।
আমার বড় ভাইয়ের বাসার ঠিকানা ছিলো ২৩০১ মরিস এভিনিউ। আমি এই ঠিকানায় উঠি। আমেরিকা তখন অনেক ঠান্ডা। এতো ঠান্ডার মধ্যে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই দুই তিন মাস বাসা থেকেই বের হইনাই।
আমাকে আমার ভাই বলল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। আমি বললাম, দেশ যখন ছেড়ে চলে আসছি কলেজে আর যাব না। কাজ করেতও ইচ্ছে করতো না। প্রায়ই বাসা থেকে বের হতাম। ম্যানহাটনের ডাউন টাউনে ঘুরে ফিরে চলে আসতাম। বলতাম কাজ করে চলে আসছি। সেলিম নামে আমার এক কলেজ বন্ধু ছিলো। ওকে নিয়ে বের হতাম।
কিভাবে চাকরি চাইব। চাকরি খুজবো এটা একটা জড়তা ছিল। আমেরিকা আসার আগে আমার ধারনা ছিল আমেরিকায় টাকার গাছ আছে। গাছে ঝাকি দিলেই টাকা পড়বে।
প্রথম কাজ টপটমেটোতে
কাজের জন্য তিনমাস ঘুরলাম। প্রথম জব হলো জেরুম এভিনিউ ভেজিটেবল এর দোকান টপ টেমোটোতে। মালিকের নাম স্টিভ। সেখানে আমাদের এলাকার এক বড় ভাই কাজে ঢুকিয়েছিলেন।
এটাই কর্ম জীবনের শুরু। ৩ টাকা ৩৫ পয়সা আওয়ার। প্রায় ৯০ থেকে ৯৬ ঘন্টা কাজ করতাম। সবজি যেদিন আসতো এক ট্রাক আসতো। দুধও আসতো ট্রাক বোঝাই করে।
ভাই বলল, তুমি আর কাজে যেতে পারবে না। প্রায় ৬ মাস কাজ করলাম। ফাকে ফাকে বাইরে আরো কাজ কর্ম দেখতাম। নিটোল নামে আমার এক বন্ধু রেস্টেুরেন্টে কাজ করতো সেভেথ এভিনিউ কিক্রোফার স্ট্রিটে। ভেজিটেবল দোকানের কাজটা ছেড়ে দিয়ে নিটোলের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে কাজ নিলাম।
দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমার কাজের যে জড়তা ছিলো তা কেটে গেলো। হ্যামবার্গাার হ্যারিস নামে আরও একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। ওয়েটার হিসেবে। সেটা ছেড়ে সেরেন্ডিটিপি ডেজার্ট দোকানে কাজ নিলাম।
ট্যাক্সি চালনা অতপর
রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আমাকে খুব আদর করতেন। কারন যেখানেই কাজ করতাম, খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতাম। নিজের মনে করে করতাম। অন্যের কাজ করছি তা মনে করতাম না। হঠাৎ আমার মাথায় খেয়াল চাপলো ট্যাক্সি চালাবো। কারন শুনলাম ট্যাক্সিতে পয়সা বেশি। রেস্টুরেন্ট থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিলাম। টানা ক্লাস করে টিএলসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম।
এরপর সিদ্ধান্ত পাক্কা। রেস্টুরেন্টে আর কাজ নয়। কাজ ছেড়ে দেবো মালিককে গিয়ে যখন একথা বললাম, তিনি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললেন। তিনি বললেন যাচ্ছো যাও। যদি কখনো মনে হয় ফিরে আসবে। দুয়ার খোলা থাকলো। ফিরে এসো।
ট্যাক্সি চালানো শুরু হলো। প্রথমদিন ১৩৫ টাকা বুকিং। ৭৫ টাকা লিজ। আমি প্রায় ৭/৮ বছর একটানা ট্যাক্সি চালালাম। আমি খুব সিরিয়াস ওয়ার্কার ছিলাম। কোন আড্ডা ছিলন।
শুরু হয় ব্যবসা
আসল কথা হচ্ছে আমার স্বপ্ন ছিলো আমি অন্যের কাজ করবো না। স্বাধীন ব্যবসা করবো। তাই কষ্টার্জিত কোন অর্থ আমি নষ্ট করিনি। যা আয় করেছি জমা করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিলো একটা বড় পূজি তৈরী করা। বাড়িতে কোন অভাব ছিলোনা। তাই তেমন একটা টাকা পয়সা দেশে পাঠাতে হতো না।
৯০ এর মার্চে প্রথম পার্টনারশীপে ব্যবসা শুরু করি । সেভওয়ে ডেলি ফাষ্টফুড। ঠিকানা ১০৩ ও ১০৪ ব্রডওয়ে। আমি, জয়নাল আবেদিন জয়নাল আর লিটন এই তিনজন মিলে ব্যবসা শুরু। ওদের সঙ্গে ৩/৪ বছর ব্যবসা করি। পার্টনাররা সবাই অন্য কাজ করতো। দোকান চালাবার লোক ছিলনা। ফলে লস শুরু হলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম এ ব্যবসা করবো না। তখন আমি এস্টোরিয়া থাকি। আমার কিছু আত্মীয় বন্ধু ব্রঙ্কসে থাকতো। বিশেষ করে পার্কচেষ্টার এলাকায়। সেই সূত্রে সেখানে যাতায়ত ছিলো প্রায় নিয়মিত।
১৯৯২ সালে ম্যাকগ্র এভিনিউতে একটা এক বেডরুমের এ্যাপার্টমেন্ট কিনি মাত্র ৬৫ হাজার দিয়ে। এস্টোরিয়া থেকে নতুন বাসায় মুভ করলাম।
তখন স্টার্লিং এভিনিউতে ফ্রেন্ডস গ্রোসারি চালু ছিল। শুনলাম গ্রোসারিটি বিক্রি হবে। কিনলাম। নাজিম সাহেব ওটার পার্টনার ছিল। ফিফটি পার্সেন্ট তাকেও শেয়ারে রাখলাম। ৭/৮ বছর ব্যবসা চালালাম। তখন আমি কন্টিনিউ ওই দোকানে বসতাম। ব্যবসা খুব ভালো চলছিল। আমার দুই ভাই রুহেল ও রুজেলও আমেরিকা নিয়ে আসলাম।
আল আমিন গ্রোসারি নামে প্রয়াত গিয়াস ভাইয়ের একটা দোকান ছিলো। এছাড়া স্টার্লিং এ তাজমহল ও পসরা নামেও আরও দুটি গ্রোসারি ছিলো।
তবে এলাকায় কোন ফ্রেশ ফিস বা তাজা মাছের দোকান ছিলোনা। ফ্রেশ ফিস খেতে হলে জ্যামাইকা যেতে হতো। তখন মাছের হোলসেল মার্কেট ছিল ম্যানটাহনের ফুলটন স্ট্রিটে।
আমি স্টার্লিং এভিনিউতে (এখন যেটা বাংলাবাজার এভিনিউ) স্টার্লিং ফিস মার্কেট খুললাম। ওটা থেকে খুব ভালো ব্যবসা হলো। খুব ভালো চলছিল। কিন্তু ওয়ার্কার পাওয়া যায়না। এই দোকান রুহেল ও রাজেল চালাত।
দুটো ব্যবসা শুরু করেছি। তবে এক টাকাও ব্যাংক লোন নেইনি। আমার একটা গুণ ছিল। আমি টাকা সেভ করতে পারতাম। টাকা আসলে এদিক সেদিক চলে যাবে তা হতে দিতাম না।
বাংলাটাউন শুরু হলো যেভাবে
একবার লন্ডন বেড়াতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাংলা টাউন নামে সুন্দর একটা সুপার মার্কেট। নাম খুব পছন্দ হলো। ভাবলাম আল্লাহ যদি চান নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে এই নামে একটি দোকান করবো।
ঘুরে এসেই এই নামে নিউজার্সির প্যাটারসনে একটি কমার্শিয়াল বিল্ডিং কিনি দুই বন্ধুসহ। দোকানটা কমপ্লিট করার পর নিউজার্সির ল’ হলো কনো দোকান করতে হলে পিপল পারমিশন লাগে। কিন্তু পারমিশন নেয়ার আগেই আগেই আমি দোকানের কাজ শেষ করে ফেলেছিলাম।
এটা ভুল ছিল।
পিপল পারমিশন পাওয়া গেলো না। তাই অনেক টাকা লস করে প্রথম বাংলা টাউন খুলতে পারিনি। কিন্তু বাংলা টাউন ঠিকই করেছি যে দোকানটা করার কথা ছিল সেটা করতে পারিনি। পরে পেটারসনের বিল্ডিং বেচে ১ লাখ ডলার লাভ করি।
ওই এলাকার ৩৬৬ ইউনিয়ন এভিনিউ আরেকটা বির্ল্ডিং কিনি। মূল্য ছিল সাড়ে ৪’শ হাজার ডলার। আমি কিনলাম ৫৫০ হাজার দিয়ে। এখন ৮’শ হাজার ডলার দাম। পেইড অফ হয়ে গেছে। এ থেকে প্রতি মাসে ৪৮০০ ভাড়া আসবে।
এর কিছুদিন পর স্টার্লিং এভিনিউতে বাংলা টাউন-১ খুললাম। এরপর ফ্রেন্ডস গ্রোসারি নাজিম ভাইকে ছেড়ে দিলাম। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো ফ্রেন্ডস গ্রোসারির সঙ্গে।
আমার মনে পড়ে নাজিম ভাইয়ের সঙ্গে যেদিন ব্যবসা শুরু করলাম। সেইদিনই ব্ল্যাক পিপলের সঙ্গে মারামারি হলো। কারন ওরা প্রায়ই দোকানে এসে রবারি করতে চাইতো। এটা ওটা নিয়ে যেতো। লোকজনকে মারধর করতো। কিন্তু আমি এর প্রতিবাদ করতাম। কাউকে ছেড়ে কথা বলতাম না। ইটের বদলে যখন পাটকেল দেয়া শুরু হলো তখন ওরা মনে করতে লাগলো এদের সাথে পারা যাবেনা। এরপর চুরি ডাকাতি কমে গেলো।
১০ বছর আগে জেরেগাতে বাংলা টাইউ-২ খুললাম। বাংলা টাউনের এই শাখাটি পপুলার হলো। ২০১১ সালে হোয়াইট প্লেইনসে টিডি ব্যাংকের পাশে একটি দোকান নেয়ার কথা হলো। এটা বাংলা টাউন-৩ হওয়ার কথা ছিলো। (এখন যেখানে দেশি বাজার) ল্যান্ড লর্ড ভাড়া চাইল ৪৫০০। আমি ৪২০০ বলায় রাজি হলো। কিন্তু এই দেশি বাজারের মালিক ৫২০০ টাকায় দোকানটা নিয়ে নিলো। আমার সঙ্গে অনেকটা প্রতিযোগিতা করে।
আমার মনে জিদ চাপলো এই এলাকায় আমি বাংলা টাউন করবোই করবো। ২০১২ সালে ওয়েস্টার এভিনিউতে এখন যেখানে বাংলা টাউন সেই দোকানটা নিলাম। এটা একটা ক্লাব ছিল। কাজ শুরু করলাম। অনেকদুর এগিয়ে গেলো। দোকান চালু করতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এরই মধ্যে চলে এলো ভায়োলেশন টিকিট।
পরে জানতে পারলাম আমাদের আর্কিটেকচার প্লানে ভুল হয়েছিল। আর পারমিশন আসার আগেই কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু লোকজন শত্রুতা করে বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টকে সে খবরটা দিয়ে দিয়েছিলো। ফলে বেশ কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখতে হলো। দোকানের কাজ শেষ করতে প্রায় ৬ মাস লেগে গেলো। সব কাজ শেষ হলো। চালু হলো আমার প্রানের বাংলা টাউন সুপার মার্কেট।
এরপর বাংলা গার্ডেন রেস্টুরেন্টের কাজে হাত দিলাম। এখন যেখানে রেস্টুরেন্ট সেখানে একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ছিল। যখনই জ্যাকসন হাইটস যেতাম হাট বাজার, খাবার বাড়ির সঙ্গে একটা করে রেস্টুরেন্ট আছে দেখতাম। এখান থেকে মাথায় আসে একটা রেস্টুরেন্ট খুলবো। খুললাম বাংলা গার্ডেন রেস্টুরেন্ট। খোলার শুরু থেকেই খুব ভালো চলছে।
দুশমনি থেকে নতুন ব্যবসার শুরু
অনেকেই জানেন বাংলা টাউন নামে স্টার্লিং এভিনিউতে আমার একটা গ্রোসারি ছিলো। একটা ছোট্ট সমস্যা নিয়ে কতিপয় মানুষ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। দুশমনি করে তারা আমার গ্রোসারির ফুড স্ট্যাম্প সুবিধা বন্ধ করে দিলো। গ্রোসারিকে পাল্টে এটিকে ডিসকাউন্ট শপ করে ফেললাম। নাম দিলাম বি এন্ড এম। ১৫ দিনের মধ্যে আমি বাংলাটাউনকে ডিসকাউন্ট শপে পরিনত করলাম। আল্লাহর রহমতে এ দোকানটিতে আমার প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ব্যবসা শুরু হলো।
জমানো টাকায় আরও দোকান
বেচাকেনা যাই হোক প্রতিদিন আমার দুই দোকান থেকে ১’শ করে প্রতিদিন দুই’শ টাকা বড় বোনের কাছে জমাতাম। অনেক দিন পর আমার বোন বলল তোমাদের টাকা নাওনা কেন। এরমধ্যে ক্যাসেলহিলে আরও একটা ডিসকাউন্ট শপ নেয়ার কথা হলো।
বোনের কাছে জমানো টাকা নিয়ে গুণে দেখলাম আড়াই লাখ ডলার জমেছে। এই টাকাতেই ক্যাসেলহিলের দোকানটি নিতে আমাকে ভিশনভাবে সাহায্য করলো। এখন আমার ৬টি দোকান। ওই ঘটনার পর থেকে ছয় দোকানে প্রতিদিন ছয়’শ টাকা জমাই। আমার স্বপ্ন ব্রঙ্কসে একটা বড় পার্টি করার। জায়গা খুজছি। এখনো পাচ্ছিনা।
বিয়ে এবং পরিবার
২০০০ সালে বিয়ে করি। ফ্রেন্ডস গ্রোসারি ও ফিস মার্কেট নামে আমার তখন দুটি দোকান। তখন ব্যবসা তুঙ্গে অবস্থান করছে। আমি এতোটাই ব্যস্ত যে বিয়ে করার মতো সময় আমার হাতে নাই। তাই আরও লেটে করতে চাইছিলাম। আরও স্টাবলিশ হতে চেয়েছিলাম। আমেরিকা আসার প্রথম ৬ মাস পর একবার দেশে গিয়েছি। এরপর ১২ বছর আর দেশে যাওয়া হয়নি। দেশে যাওয়ার পর আমার মা ধরলেন বিয়ের জন্য।
এটা ২০০০ সালের ঘটনা। সবাই চেপে ধরল। আমার ফুফাতো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো। দেখতে আসলো। অবশেষে রাজি হলাম। বিয়ের ইন্টারভিউ হলো। কনে পক্ষের কাছে সব সত্য কথা বললাম। ট্যাক্সি চালাতাম তাও বললাম। বিয়ে হয়ে গেলো। আমার স্ত্রী চার দাদির একমাত্র নাতনি। এক বাবার এক মেয়ে। বিয়েটা এতো কিম সময়ে হলো যে সময়ের অভাবে বিয়ের কার্ড পর্যন্ত করা হয়নি।
২১ বছরের দাম্পত্য জীবন। খুব সুন্দর জীবন কাটাচ্ছি আমরা। আমি কাজ পাগল মানুষ। ১৪-১৫ ঘন্টা কাজে থাকি। বিয়ের সময় বলে নিয়েছি। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। সন্তান এবং ভাইবোনদের নিয়েই আমার সুখের পারিবারিক জীবন।
লাইফ স্টাইল
ঘুম থেকে উঠি সকাল ১০ টায়। দিনের শুরুতে নামাজ পড়ি। তারপর নাস্তা খাই। কোনদিন পরোটা, কনোদিন ভূনা খিচুড়ি, পিঠা। দুপুরে খাবার বাসায় খাওয়া হয়না। রেস্টুরেন্টে খাই। কোনদিন রুটি খাই, কোনদিন ভাত খাই।
তবে চেষ্টা করি অন্তত একবেলা পরিবারের সবার সঙ্গে খাবার খেতে। এই ধারাবাহিকতায় রাতে সব সময় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসে ভাত খাই। আগে ভাইবোনদের নিয়ে একসাথে খেতাম। এখন ব্যবসা বাড়ায় ভাইয়েরা সময় দিতে পারেনা।
যখন কাজে থাকি তখন কোন বিশ্রাম নেই না। নিজেকে সুস্থ রাখতে নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করি। আর এমনিতে আল্লাহর রহমতে আমার কোন রকম শারিরিক অসুস্থতা নেই। আমি সব সময় হাসিখুশি থাকি। মানুষের মধ্যে থাকতে পছন্দ করি। একা সময় খুব কম কাটাই। এটাই আমাকে প্রানবন্ত থাকতে সাহায্য করে।
সোস্যাল ওয়ার্ক
আমি বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন কমিশনার ছিলাম। জালালাবাদ এসোসিয়েশনে এর সঙ্গে সব সময় জড়িয়ে থাকি। এছাড়া পার্কচেষ্টার জামে মসজিদে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বাংলাবাজার বিজনেস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। আর বাংলাদেশ সোসাইটি ব্রঙ্কস এর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছি। বর্তমানে নর্থ ব্রঙ্কস বিজসেন এসোসিয়েশেনর প্রধান উপদেষ্টা।
আমার উদ্যেগে ব্রঙ্কসে প্রথম পথমেলা শুরু করি। বাংলাদেশ সোসাইটি ব্রঙ্কস এর ব্যানারে। এছাড়াও বাংলা স্কুলের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছি।
আরও যত গুণ
ভালো রান্না জানি। বিশেষ করে মাংশ ও তান্দুরি। খেলা দেখতে পছন্দ করি। নিউইয়র্ক ইয়াংকি, নিউইয়র্ক নিক্স, নিউইয়র্ক রেইনজার খেলা দেখতে যাই। সন্তানদের নিয়ে যাই।
মৃত্যুর আগে যে কাজ করে যেতে চাই
আমার একটা ইচ্ছা আমার দেশে এতো জায়গা রয়েছে একটি বৃদ্ধাশ্রম করে যেতে চাই। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন। সন্তাদের গড়ে তুলে যেতে আলোকিত ভালো মানুষ হিসেবে।
যেসব কারনে আমি সফল
১. দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা
২. সেভিংস। সেভ করার অভ্যাস।
৩. স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা
৪. মা-বাবা ভাইবোনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা
৫. পারিবারিক ঐক্য।