খবর প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারী, ২০২৪, ১১:২৭ পিএম
নিউইয়র্ক: ‘বাঁচাতে মায়ের মান দিয়ে গেছো নিজ প্রাণ/হয়ে গেছো ক্ষতবিক্ষত/ নিশ্চিত মরণ জেনে দাওনি ক্ষান্ত রণে/করনি তো তাও মাথা নত।/তোমরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।/হে বীর মুক্তিযোদ্ধা তোমরা লও সালাম।’
এমন আবাহনী সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় আবিষ্ট হয়ে প্রবাসের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের সমাবেশ হলো ১৬ জুলাই রবিবার নিউইয়র্ক সিটির উডসাইডে গুলশান টেরেসের আলো ঝলময় মিলনায়তনে। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাগণের পরিবার-পরিজন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত প্রবাসীরাও।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত এম এ মোহিত ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ সম্মানীত অতিথি ছিলেন বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত ৩ নারী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একমাত্র জীবিত ক্যাপ্টেন (অব:) ডা. সিতারা রহমান, বীর প্রতিক মেজর (অব:) মঞ্জুর আহমেদ, একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়লা হাসান, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী ও কন্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় এবং শহীদ হাসান, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ রিপি।
অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারি এবং পরবর্তীতে পানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ড. সুফিয়ান এ খন্দকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবিদুর রহমান, কম্যুনিটিতে নিরব সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত এমটিএর ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুল হক এবং জনপ্রিয় স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সায়েরা হক, উত্তর আমেরিকায় মানবকল্যাণমূলক কাজে খ্যাতি অর্জনকারি এবং শহীদ পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহাম্মেদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী হোসেন এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (প্রেস)এ জেড এম সাজ্জাদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত মোহিত তার ৩টি অনুভূতির কথা উপস্থাপন করেন। প্রথমত: যখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাগণের সংস্পর্শে আসেন তখন তার মধ্যে নির্জলা গৌরব আর আনন্দ-অনুভূতি, বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরবের ঘটনা, জাতির পিতার নেতৃত্বে সংঘটিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে যারা জড়িয়ে গেছেন সেই থেকে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের সংস্পর্শে যখন আসি তখন আমি গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হই। দ্বিতীয় অনুভূতি হচ্ছে দুঃখ আর হতাশার।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। সে সময় আমি না যেতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধে কিংবা দেখতেও পারিনি অথবা বুঝারও তেমন অবস্থা হয়নি। আমাদের প্রজন্মের অথবা পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অনেক কিছু হয়েছি এবং হবো, কিন্তু যে জিনিসটা আমরা কখনই হতে পারবো না সেটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। আমরা কখনোই মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। এমন একটি হতাশা আর দুঃখবোধ আমাকে সবসময় তাড়িত করে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে গ্লানি। আমার কাছে যেটা মনে হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ যে স্বপ্ন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এতো আত্মত্যাগ, এত রক্ত, এত ঘাম ঝরিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আমার মনে হয় আমরা পরবর্তী প্রজন্ম সেটার সঠিক মর্যাদা এখনও দিতে পারিনি। এমনকি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সপরিবারে জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর একটি লম্বা সময় ধরে এই জাতীয় বীরেরা সঠিক স্বীকৃতি, সম্মানও পাননি। সৌভাগ্যের বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এবং আমার ধারণা সামনের দিনগুলোতে তা আরো উজ্জ্বলতর হবে।
ক্যাপ্টেন (অব:) সিতারা রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং বিশ্রামগঞ্জে ৪০০ সিটের হাসপাতালে রাতে হারিকেনের আলোতে (কখনো কখনো টর্চ লাইটের আলোতে) কীভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাগণের অস্ত্রোপচার করেছেন-তার আলোকপাত করেন।
লেফট্যানেন্ট থেকে কীভাবে ক্যাপ্টেন হলেন সিতারা বেগম তাও বিবৃত করেন এ সময়। আবিদুর রহমানের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় ডা. সিতারা রহমানে পরিণত বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিশ্রামগঞ্জে আমরা হাসপাতাল কীভাবে পরিচালনা করছি তা দেখতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী। সে উপলক্ষে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাগণও এসেছিলেন হাসপাতালে। সে সময় ওসমানী সাহেব আমাকে বারবার ক্যাপ্টেন হিসেবে অভিহিত করেন। সেই থেকে আমি হয়ে গেছি ক্যাপ্টেন সিতারা রহমান।
শারমিন আহমদ রিপি বলেন, আমাদের বাঙালি জাতির ক্রান্তিলগ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটি জিনিস দিতে চেয়েছিলেন সেটি ছিল প্রাণ। এটা যে কত বড় একটি ত্যাগের সংকল্প এবং আজ আমি সেই মানুষগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। তাই আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন-অভিবাদন আমাদের প্রাণপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ভাই ও বোনদের প্রতি।
আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ এর যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার এবং পরিচালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি। পুরো আয়োজনের সামগ্রিক সমন্বয়-সাধন করেছেন ফোরামের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার চুন্নু, যুগ্ম সম্পাদক আলিম খান আকাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক উইলি নন্দি এবং নির্বাহী সদস্য নুরুন্নাহার খান নিশা।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নির্বাহী সদস্য শামীম আকতার শরিফের লেখা ও সুরে আবাহনী সঙ্গীতের পরই সিতারা রহমান বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার আগে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতেও নেতৃত্ব দেন শামীম।