খবর প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারী, ২০২৪, ১১:২৮ পিএম
নিউইয়র্ক: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ রিপি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কি কেবলই ৯ মাসের যুদ্ধ ছিল? এর নেপথ্যে যে প্রজ্ঞা, লিডারশিপ, সামরিক-বেসামরিক সর্বক্ষেত্রে মানুষের প্রতিভা, মানুষের তীব্র আত্মত্যাগের নিউক্লিয়াসটা আমরা দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পাঠ্যসূচিতে, আমাদের ন্যাশনাল ডিসকাশনে এই মুক্তিযুদ্ধ পর্ব হয়ে গেছে মারাত্মকভাবে অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধের মূল তারকারা আজ ফুটনোটে, আমি বলবো, ওনারা এক্সাইল হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লেখক ও গবেষক শারমিন আহমদ রিপি বলেন, তাদের সেই বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে শতশত নাম জানা নারী-পুরুষ যোদ্ধা তাদের স্টোরিটাকে সামনে আনলে এটাই হবে কখনো যদি জাতি আবারো কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন হয়, এই মুক্তিযুদ্ধ হবে তাদের তীর্থস্থান, নিউক্লিয়াস, তাদের প্রেরণার ক্ষেত্র। তাই সে সব সাহসী যোদ্ধাদের বন্দি করে জাতি হিসেবে আমরা আসলে কতখানি এগোতে পারছি।
তিনি উল্লেখ করেন, এখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) আমরা হলোক্যস্ট মিউজিয়াম দেখি, আব্রাহাম লিঙ্কন মেমোরিয়াল দেখি, জর্জ ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল দেখি, আমরা নানা নক্ষত্রকে চিনছি, অথচ আমাদের বাংলাদেশে কিন্তু ব্যাপারটা ওভাবে আসে না। সবকিছু এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সে অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে।
শারমিন আহমদ রিপি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, একটা জাতীয় যুদ্ধ। আমাদের ডিসকাশনে, প্রোগ্রামে, পাঠ্যসূচিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সবকিছুকে স্থান দিতে হবে।
নিউইয়র্কে অনুষ্ঠানরত চার দিনব্যাপী বইমেলার দ্বিতীয় দিন শনিবার দুপুরে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর পর অনুষ্ঠিত আলাপচারিতায় শারমিন আহমদ রিপি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, এমন চিন্তাকে বিবেচনা করে আমরা ক’জন নিজেরা কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয়ে (কারো কাছে কোনো অনুদান ছাড়াই) একটি ডকুমেন্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাই পাশে দাঁড়ালেন। সে প্রেরণা থেকেই আমরা এসব নির্মাণ করেছি ‘গিফট টু আওয়ার ন্যাশন’ হিসেবে। এগুলো দেখে যদি মানুষ কিছুটাও উপকৃত হয়, তাহলেই আমরা নিজেদের ধন্য মনে করবো।
রিপি বলেন, ইতিমধ্যেই ‘জনযুদ্ধ ৭১’ নামক ছবিটি চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর ও টঙ্গি ইত্যাদি স্থানে নিয়ে গেছি। ঢাকাতেও প্রদর্শিত হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। তরুণরা ছবিটি দেখার পর প্রত্যেকে একই কথা বলেছে যে, এই তথ্যগুলো আমরা কেন জানি না যে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পানির তলে ওয়ার্ল্ডের অন্যতম বৃহত্তম একটি আক্রমণ করেছিলেন? আত্মঘাতী হামলায় পাকিস্তানি ৩৫টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন? এই স্টোরি তো আমরা পাচ্ছি না আমাদের গল্পে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদে নিজ হাতে কাপড় পরিষ্কার করতেন? কোনো পারিবারিক জীবনযাপন করেননি-এটা তো আমরা জানি না আমাদের লেখাপড়া-আলোচনায়। আমরা তো জানি না যে, প্রথম বিমান হামলাটি আমরা (গেরিলারা) করেছিলাম, ভারত নয় এবং আমাদের যুদ্ধ আমরা করবো, এই প্রত্যয়? আমরা তো জানছি ভারত এসে আমাদের যুদ্ধটা করে দিয়েছিল।’ এভাবেই আমাদের নিজস্ব স্টোরিটা সেভাবে বলছি না বা লিখিনি। তো অন্যরা তো সেই জায়গা নেবেই। তারা তাদের ক্রেডিট নেবেই, তবে আমরা এই ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের ক্রেডিট আমরা নিতে চাচ্ছি। সর্বস্তরের পাঠ্যসূচি ডিসকাশনে, কারিকুলামে সব জায়গায় যেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সঠিকভাবে পরিচালনাকারীদের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস উপস্থাপতি হয়।
স্বল্পদৈর্ঘ্য অপর চলচ্চিত্রগুলো ছিল- ‘বীর চট্টলার প্রতিরোধ যুদ্ধ’, ‘মুজিবনগর : বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সরকার’, ‘বিলনিয়ার যুদ্ধ’, ‘আকাশে মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘একাত্তরের নৌ-কমান্ডো’। সাংবাদিক ও লেখক শামিম আল আমিনের সঞ্চালনায় এ আলোচনায় আরও অংশ নেন ড. আহমাদ আহসান এবং ডা. প্রতাপ দাস। একইসঙ্গে ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শীর্ষক আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
দিবসের অপর কর্মসূচির মধ্যে ছিল ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ শীর্ষক নির্বাচিত কবিতা আবৃত্তি, ‘একুশ থেকে একাত্তর’ শীর্ষক আলোচনা, সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে আলাপচারিতা, ‘প্রিন্ট বনাম ডিজিটাল মিডিয়া’ শীর্ষক ডিসকাশন, ছড়াপাঠের অনুষ্ঠান ‘আমরা ধরাকে ছড়াজ্ঞান করি’ এবং বাঙালি আড্ডা। আরও ছিল বাফার উদ্যোগে ‘আমার জন্মভূমি’ শীর্ষক নৃত্যালেখ্য, নজরুলের গানভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘অঞ্জলি লহ মোর’। জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের সবুজ চত্বরে বসেছে নতুন বইয়ের স্টল। হাজারো প্রবাসীর সমাগম ঘটছে এই মেলার বিভিন্ন পর্বে।