লুবনা মরিয়ম। একজন নৃত্য গবেষক ও নৃত্যশিল্পী। ‘সাধনা’ (আ সেন্টার ফর দ্যা অ্যাডভান্সড অব সাউথ এশিয়ান কালচার) নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তিনি।  মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী ক্যাম্পে শরণার্থীদের সেবা শুশ্রুষার কাজে সহায়তা করতেন। শরণার্থী ক্যাম্পের এতিম শিশুদেরও দেখাশোনা করতেন। ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পেও। সম্প্রতি ওই সময়ের স্মৃতি, কর্মকাণ্ড ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তাসলিমা তামান্না। সাক্ষাৎকারটি প্রবাসনিউজ  ডট কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

 

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন? সেই সময়ের কথা…

লুবনা মরিয়ম : ঢাকাতেই ছিলাম পরিবারের সঙ্গে। যুদ্ধ তো হঠাৎ করে শুরু হয়নি। অনেকদিন ধরেই আন্দোলন হচ্ছিল। আমরা আন্দোলন করছিলাম অধিকার আদায়ের জন্য। হলফ করে বলতে পারি, ৯৯ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানি কখনও ভাবেনি স্বাধীন একটা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এমনকী ৭ মার্চ ভাষনের পরও আমাদের মনে হচ্ছিল সেটা কোনো আলাপ আলোচনার পূর্ব শর্ত। কিন্তু ২৫ মার্চের পর আমরা বুঝতে পারলাম, বর্বর একটা দেশের আর থাকা যায় না। একাত্তর আমার কাছে কোনো স্মৃতি নয়। যখনই একাত্তর নিয়ে কথা বলি মনে হয়, গতকালের ঘটনা। একাত্তর আমার কাছে একটা ট্রমা। কম বয়সের যদি কোনো ট্রমা হয়, সেটা সবসময় বর্তমান হয়ে থাকে।

 

প্রশ্ন : আপনার বাবা বীর উত্তম লে. ক. কাজী নূরুজ্জামান যখন যুদ্ধে যান তখন কোথায় ছিলেন?

 

লুবনা মরিয়ম : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৭, বড় বোন নায়লার ১৮, আর ভাইয়ের ১৫ বছর। ওই বয়সে আমরা আসলে কী করব সেটা আমাদের বাবা-মাই নির্ধারণ করতেন। বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন আত্মীয়স্বজন আমাদের রাখতে চাইল না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাবার নাম ঘোষণা করার পর তারা সবাই ভয় পেলেন। আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। জুনে ওয়াহিদ ভাই আমাদের টাঙ্গাইলের একটা গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। বাবা তখন বহরামপুরের লালগোলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ছিলেন। আমাদের জন্য আগরতলায় এসে বাবা অপেক্ষা করছিলেন। পরে তার সঙ্গে আমরা মালদহ যাই। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

 

প্রশ্ন : সেখানে গিয়ে কী করলেন?

 

লুবনা মরিয়ম : আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সুলতানা জামান বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি তৃণমূল কর্মী ছিলেন। ওই সময় নদীয়ার কল্যাণীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্ত্ত শিবির ছিল। ভারতীয় লেখক মৈত্রেয়ী দেবীর সংস্থা সেই উদ্বাস্তু শিবিরে কাজ করছিল। হাজার হাজার মানুষ ছিল সেখানে। অনেকেই অসুস্থ হচ্ছিলেন। তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া, ডাক্তার নিয়ে আসা চলছিল। তখন মা বললেন, ঠিক আছে আমিও আমার দুই মেয়েকে নিয়ে কল্যাণীতে কাজ করব। পরে সেফ দ্য চিলড্রেনের আরেকটা ছোট হাসপাতালেও আমরা কাজ করতে লাগলাম। যখন ড. সানজীদা খাতুন শুনলেন আমরা কল্যাণীতে আছি, তখন তিনি গান গাওয়ার জন্য নায়লাকে (বড় বোন) ডাকতেন। যখনই কোনো বড় অনুষ্ঠান থাকত নায়লা বাসে করে কলকাতা চলে যেত। এছাড়া মৈত্রেয়ী মাসি ‘কল্যাণী’র অনাথ শিশুদের নিয়ে ‘খেলাঘর’ নামে একটা আশ্রম করলেন । আমরা ওখানেও কাজ শুরু করলাম। অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করা, পড়াশোনা করানো সব কিছুই করতাম।