আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বরে যেদিন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা যান, তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ব্রিটেনের নতুন রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেন চার্লস। এরও আট মাস পর গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে মুকুট পরিয়ে তার অভিষেক সম্পন্ন হলো।

তবে নতুন রাজার জন্য সব কিছু যত সহজ বলে মনে হচ্ছে, ততটা সহজ নয়। রাজা তৃতীয় চার্লস এমন এক সময়ে সিংহাসনের ভার নিয়েছেন, যখন যুক্তরাজ্য এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। বিবিসি যেসব ইতিহাসবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তারা বিশ্বাস করেন নতুন রাজা ‘অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়বেন। যুক্তরাজ্যে জ্বালানি সংকটের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সব কিছুর ওপর। অন্যদিকে রানি এলিজাবেথের ৭০ বছরের শাসনকাল শেষ হওয়ার পর রাজপরিবার সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বদলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লসের সামনে কঠিন পরীক্ষা।

নতুন রাজাকে এখন যেসব ইস্যুর মোকাবেলা করতে হবে, এখানে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো :

বাস্তবতাবোধসম্পন্ন রাজতন্ত্র?
ইউক্রেন যুদ্ধের পর হতে ব্রিটিশ জনগণ মারাত্মক জ্বালানি সংকটে ভুগছে। গত শীতে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের সাংঘাতিক ভুগতে হয়েছে। অনেক পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ তাদের জ্বালানির বিল শোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খাবে, অর্থাৎ ব্রিটেনের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ।

এ রকম পরিস্থিতিতে রাজপরিবারের আর্থিক ব্যয় নিয়ে এখন অনেক বেশি প্রশ্ন উঠবে। সত্যি কথা বলতে কি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ব্রিটিশ সংবাদপত্রে জল্পনা ছিল, তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোর আড়ম্বর এবং আকার ছোট করে আনার পক্ষে। এমনকি তার অভিষেক অনুষ্ঠানও।

১৯৫৩ সালে যখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক হয়, সেটি ছিল টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা প্রথম কোনো অভিষেক অনুষ্ঠান। সেটির তুলনায় রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান ছিল অনেক সংক্ষিপ্ত, সেই সঙ্গে বর্তমান ব্রিটিশ সমাজের বৈচিত্র্য তুলে ধরতে এটিতে বহু-সংস্কৃতির অংশগ্রহণ এবং প্রতিফলন ছিল।

চার্লস এর আগেও রাজতন্ত্রের কলেবর ছোট করে আনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এর ফলে হয়তো রাজপরিবারে আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে, যার কেন্দ্রে থাকবেন রাজা চার্লস এবং রানি ক্যামিলা, প্রিন্স উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন।

রাজকীয় ইতিহাসবিদ কেলি সোয়াব বিবিসিকে বলেন, ‘এমন সম্ভাবনা আছে যে সব কিছুর কলেবর কমিয়ে আনা হবে। দেশে এখন যে কঠিন সময় যাবে, রাজপরিবার যে তা অনুধাবন করতে পারে, সেটা তাদের দেখাতে হবে।’

 

রাজপরিবারের আর্থিক খরচের বিষয়টি বেশ জটিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেন, তারা বেশির ভাগ সময় এটিকেই মূল যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। কারণ এই অর্থ মূলত আসে করদাতাদের কাছ থেকে। রাজপরিবারের জন্য এই অর্থ প্রতিবছর একটি বার্ষিক মঞ্জুরির মাধ্যমে জোগান দেওয়া হয়। যেমন ২০২১-২২ বছরে এই মঞ্জুরির পরিমাণ ছিল প্রায় দশ কোটি ডলার। অর্থাৎ ব্রিটেনের প্রত্যেক নাগরিক মাথাপিছু প্রায় দেড় ডলার করে দিচ্ছেন রাজপরিবারের জন্য।



 

 

ভাবমূর্তি এবং সমর্থন কমছে
ব্রিটেনে মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য যে জরিপ চালানো হয়, তাতে রাজতন্ত্র এবং রাজপরিবার সম্পর্ক মানুষের মনোভাব জানতে প্রশ্ন রাখা হয়। এই জরিপে দেখা যায়, গত ৩০ বছরের মধ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে।

অভিষেক অনুষ্ঠানের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে বিবিসির পক্ষ থেকে একটি জনমত জরিপ চালানো হয়। এতে যদিও ৫৮ শতাংশ মানুষ রাজতন্ত্র অব্যাহত থাকা উচিত বলে মত দিয়েছেন, তরুণদের মধ্যে এই সমর্থন কিন্তু অনেক কম। এক-তৃতীয়াংশেরও কম তরুণ রাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে।

রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে জনপ্রিয়তার সূচকে অনেক বছর চার্লস ছিলেন তিন নম্বরে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং তার নিজের ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামের পেছনে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নতুন রাজার প্রতি সমর্থন কিছুটা বেড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে জরিপে। তবে রাজপরিবারের ভাবমূর্তি বাড়াতে তাকে অনেক কাজ করতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।

ইতিহাস গবেষক রিচার্ড ফিটযউইলিয়াম বলছেন, ‘তার একটি চ্যালেঞ্জ হবে তরুণ প্রজন্মের কাছে রাজতন্ত্রের আবেদন তৈরি করা।’

অন্যদিকে কেলি সোয়াব বলছেন, ‘১৯৫২ সালের পর থেকে পরিস্থিতির অনেক বদল হয়েছে।’ ওই বছর দ্বিতীয় এলিজাবেথ রানি হন। তিনি বিশেষ করে গত কয়েক দিনে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে এখন রাজপরিবারের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধ অনেক কম। এখন রাজপরিবারকে অনেক বেশি প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। রাজা চার্লসকে এই বিষয়টা বিশেষ করে মনে রাখতে হবে।’

‘কোনো অনুযোগ নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়’
রাজা তৃতীয় চার্লস হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ব্রিটেনের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে তার ক্ষমতা খুবই সীমিত, তিনি প্রতীকী এবং আলংকারিক কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন। কাজেই রাজপরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে হয়।

প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ নাকি ‘কোনো অনুযোগ নয়, কোনো ব্যাখ্যা নয়’—এমন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি যে একেবারে সংযত ছিলেন, সেটির পেছনে ছিল তার এই নীতি।

তবে রাজা চার্লস কিন্তু অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, সেসব বিষয়ে নিজের কথা তিনি বলেছেন। যেমন ২০১৫ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীর তহবিল হতে শুরু করে ভেষজ ঔষধ—এ রকম নানা বিষয়ে তিনি মন্ত্রীদের কাছে অনেক চিঠি লিখেছেন।

এখন কি তিনি তার অবস্থান বদলাবেন? সাংবিধানিক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ভার্নন বোগডানর মনে করেন, সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তিনি প্রথম দিন থেকেই জানেন যে তার স্টাইল এখন বদলাতে হবে। অনুযোগ করছে এ রকম একজন রাজাকে লোকে মানতে চাইবে না।’

গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর যখন নতুন রাজা চার্লস প্রথম পার্লামেন্টে ভাষণ দেন, তখনই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি নিজেকে নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন, তার নিজের অনেক আগ্রহের বিষয় নিয়ে তিনি এখন আর কাজ করতে পারবেন না। রাজা তৃতীয় চার্লস আরো বলেছিলেন, পার্লামেন্ট হচ্ছে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ‘জীবন্ত অঙ্গ’।

কমনওয়েলথ এবং ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার
রাজা তৃতীয় চার্লস তার মায়ের মৃত্যুর পর এখন কমনওয়েলথের নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কমনওয়েলথ হচ্ছে ৫৬টি দেশের একটি রাজনৈতিক জোট, যাদের বেশির ভাগই আসলে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ। তিনি একই সঙ্গে যুক্তরাজ্য ছাড়াও আরো ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এর মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জ্যামাইকা এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ।

তবে গত কয়েক বছরে কমনওয়েলথের কিছু দেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রশ্নে। এই প্রক্রিয়ায় বার্বাডোস ২০২১ সালে নিজেদের প্রজাতন্ত্র ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে ওই দ্বীপে বহু শত বছরের ব্রিটিশ প্রভাবের অবসান ঘটে, রানিকে তারা রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করে। আটলান্টিকের দুই তীরে দাস ব্যবসার ক্ষেত্রে বার্বাডোস খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র ছিল।

প্রিন্স উইলিয়াম যখন ২০২২ সালে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সফরে যান, তখন সেখানে উপনিবেশবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সেখানে দাস ব্যবসার জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছিল। জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী এন্ড্রু হোলনেস তো প্রকাশ্যেই প্রিন্স উইলিয়ামকে বলেছিলেন, তার দেশ অতীত পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চায়।

বিবিসির রাজকীয় সংবাদদাতা শন কোলান বিশ্বাস করেন, রাজা চার্লসের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে কমনওয়েলথের সঙ্গে একটি আধুনিক সম্পর্কের কাঠামো দাঁড় করানো। তিনি বলেন, ‘কমনওয়েলথের নতুন প্রধান হিসেবে তিনি যখন এসব দেশ সফরে যাবেন, তখন তিনি কিভাবে উপনিবেশের ইতিহাস এবং দাসপ্রথার মতো ইস্যুগুলোর মোকাবেলা করবেন?’

প্রবীণ বয়সে রাজদায়িত্ব
রাজা তৃতীয় চার্লসের বয়স এখন ৭৪। তিনি ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে রাজা হয়েছেন। তার প্রতিদিনের রাজকার্য পরিচালনার সময় যে প্রশ্নটি উঠবে, তা হলো, রাজকীয় দায়িত্বের যে বিপুল ভার, তার কতটা তিনি নিজে পালন করতে পারবেন।

এমন জল্পনা চলছে, তার বড় ছেলে এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়ামকে এ ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব পালনের ভার নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের বেলায়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও আশির কোঠায় পা দেওয়ার পর তার এ রকম বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করেছিলেন।

ইতিহাসবিদ কেলি সোয়াব বলছিলেন, ‘রাজা চার্লস একজন বৃদ্ধ রাজা। তিনি নিজে একা সব করতে পারবেন না। আমার মনে হয়, এ কারণে বিভিন্ন দায়িত্বে আমরা প্রিন্স উইলিয়ামকে অনেক বেশি দেখতে পাব।’

‘বিরাট প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে’
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর সারা দেশে যে রকম শোকের ছায়া পড়েছিল, তাতে বোঝা যায় তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। সেটাও রাজা তৃতীয় চার্লসের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তবে ইতিহাসবিদ ইভালিন ব্রুটন বলেন, এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা কঠিন নয়।

এ ক্ষেত্রে ১৯০১ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড যে পটভূমিতে সিংহাসনে আসেন, তার কথা উল্লেখ করছেন। রানি ভিক্টোরিয়াও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।

ইভালিন বলেন, ‘ভিক্টোরিয়ান যুগের অবসান হয়েছিল যখন, তার সঙ্গে আমাদের বর্তমান সময়ের অনেক মজার মিল আছে। সপ্তম এডওয়ার্ড এবং তৃতীয় চার্লস, দুজনই এমন সময়ে দায়িত্বে এসেছেন, যখন ব্রিটেনে অনেক সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে এবং দুজনেই তাদের পূর্বসূরি তাদের মায়েদের মতো অত জনপ্রিয় নন।’

সপ্তম এডওয়ার্ড সিংহাসনে ছিলেন মাত্র ৯ বছর (১৯০১-১৯১০)। তবে তিনি নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশেষ করে রাজা হিসেবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় তিনি যে কূটনৈতিক ভূমিকা রাখেন। ১৯০৪ সালে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে এই সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়।

ইভালিন বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সপ্তম এডওয়ার্ড বেশ ভালোই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কাজেই রাজা তৃতীয় চার্লসকেও যে একইভাবে মানুষ মনে রাখবে না, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তার সামনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো একজন আদর্শ রানির উদাহরণ আছে। তিনি এই দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেয়েছেন।’

সূত্র : বিবিসি