আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য বরিস জনসনেই আস্থা রেখেছেন রক্ষণশীল আইন প্রণেতারা। যার অর্থ দাড়াচ্ছে, রাজনীতির ক্যারিয়ার আপাতত টিকে গেল তার। কিন্তু সঙ্কট থেকে কি আদৌ মুক্তি পেলেন?
রক্ষণশীলদের আস্থা ভোটে বরিস জনসনের পক্ষে রায়ের পরদিন মঙ্গলবার সিএনএনের এক প্রতিবেদনে তার ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে বরিস জনসনের এখনও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কারণ আস্থা ভোটে জনসনের পক্ষে সংখ্যাটি তার এবং তার সমর্থকদের প্রত্যাশার চেয়ে কম।আস্থা ভোটের এই ফল যুক্তরাজ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির তথা দেশের নেতৃত্ব দিতে জনসনের অবস্থানকে নড়বড়ে করে তুলেছে।
সোমবার কী ঘটেছে?
প্রধানমন্ত্রী জনসনের নিজের দলের অন্তত ৫৪ জন আইনপ্রণেতা অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সে কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ সদস্য - প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে আস্থা ভোট চেয়ে কনজারভেটিভ পার্লামেন্টারি গ্রুপ ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে গোপনীয় এক পত্রে আবেদন জানালে চেয়ারম্যান সেই ভোট ডাকেন।
১৯২২ কমিটির এখনকার চেয়ারম্যান গ্রাহাম ব্রাডি। সোমবার তিনি জানান, আস্থা ভোট চেয়ে আবেদনকারী দলীয় এমপির সংখ্যা ১৫ শতাংশ (এই হিসাবে ৫৪ জন, যারা ব্যাকবেঞ্চার এমপি হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ তারা সরকারের কোনো পদে নেই)। এর ফলে সোমবার আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। জনসনের পক্ষে ভোট দেন ২১১ এমপি। বিপক্ষে ভোট পড়ে ১৪৮টি। এরপর জনসনই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থাকছেন জানিয়ে পার্লামেন্টের ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান গ্রাহাম ব্রাডি ভোটের ফল ঘোষণা করেন। দলের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী জনসনের উপর এখনও আস্থা আছে কি না, সে সিদ্ধান্ত জানাতে হাউজ অব কমন্সে গোপন ব্যালটে ভোট দেন কনজারভেটিভ এমপিরা।
কেন এতটা চাপে জনসন?
কোভিড মহামারীতে জারি থাকা লকডাউনের বিধি ভঙ্গ করে মদের পার্টি আয়োজনের কেলেঙ্কারির জেরেই দলের ভেতর নেতৃত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন বরিস জনসন, যা ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে ‘পার্টিগেইট’ বা ‘পার্টি কেলেঙ্কারি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যে দেশবাসীকে বিধিনিষেধে আটকে রেখে তিনি নিজে মদপানের পার্টিতে উপস্থিত থেকেছেন।
২০২১ সালের ১৬ এপ্রিলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, তখনও প্রধানমন্ত্রীর ডাউনিং স্ট্রিটের কার্যালয়ে কর্মীরা আরও দুটো মদের পার্টি করেছিলেন। তখনও বদ্ধ জায়গায় জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে চলছিল জাতীয় শোক। তবে সিএনএন জানাচ্ছে, দলের ভেতরে বিদ্রোহের কারণগুলোর মাত্র একটি হচ্ছে ‘পার্টিগেইট’।
যুক্তরাজ্যে বর্তমানে জীবযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, উত্তর ইংল্যান্ডে নতুন পরিবহন সংযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, ব্রেক্সিটের পর নর্দান আয়ারল্যান্ড প্রটোকল নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেও সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জনসন।
ভোটের ফল কি অবাক হওয়ার মতো?
সিএনএন বলছে, এই প্রশ্নের উত্তরটি ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। জনসন আস্থা ভোটে উৎরে যাবেন- এমনটাই প্রত্যাশিত ছিলো, যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের প্রায় ১৮০ জন এমপি কোন না কোনভাবে সরকারি পদে থেকে বেতনভাতা পাচ্ছেন, যাদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ও দলের ভাইস চেয়াররাও রয়েছেন।
জনসন এবং তার মিত্ররা দলের ভেতরে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে ভোটের ফল নিজেদের অনুকূলে আনতে পারলেও, চূড়ান্ত ভোটের ফলাফলটা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। যত সংখ্যক ভোট তারা নিজেদের পক্ষে আশা করেছিলেন তার চেয়ে অনেক কম ভোট পেয়েছেন। এমনকি ভোটের আগে কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমন মন্তব্যও করেছিলেন যে যদি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১০০ বা তার বেশি সংখ্যক এমপি অনাস্থা জানায়, সেক্ষেত্রে তিনি গুরুতর সঙ্কটে রয়েছেন।
জনসন কি নিরাপদ অবস্থানে গেছেন?
একভাবে বলা যায়, আপাতত এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। কনজারভেটিভ পার্টির বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, সোমবার জিতে যাওয়ায় জনসনের আগামী অন্তত এক বছরের জন্য আর আস্থা ভোটের মুখে পড়ার কথা নয়। তবে এই নিয়ম যে কোনো সময়ই পরিবর্তনযোগ্য। আর অনেকেই ধারণা করছেন, এমনটা হতেই পারে।
জনসনের পরের বড় সঙ্কটগুলো কী?
নিজের দলের আইনপ্রনেতাদের একটি বড় অংশ জনসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তার জনপ্রিয়তা ও সুনামকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আইনসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করানোও এখন তার জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বেরেনবার্গ ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ কালুম পিকারিং তার গ্রাহকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, “জনসনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যত সংখ্যক এমপি ভোট দিয়েছেন তাদের মোট সংখ্যাটি হাউজ অব কমন্সে কনজারভেটিভ পার্টির কার্যকর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ৭৫টি আসনের চেয়ে বেশি। তাই বিদ্রোহী এমপিরা যদি সিদ্ধান্ত নেন তারা সরকারের আইনপ্রণয়ন প্রক্রিয়া আটকে দেবেন, তারা সেটা করতে পারবেন। ফলে জনসনের নেতৃত্বাধীন সরকারে একটি স্থবিরতা দেখা দিতে পারে যা আদতে ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তা আরও কমিয়ে দেবে।”
এছাড়া জুনের শেষ নাগাদ দুটি কঠিন উপনির্বাচনে লড়তে হবে জনসনের কনজারভেটিভ পার্টিকে। নিজেদের কেলেঙ্কারির জেরে কনজারভেটিভ পার্টির দুই ব্যাকবেঞ্চার এমপি পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় এই উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে এবং এই ভোটে হারলে ২০২৪ সালের আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে আরও চাপে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন বরিস জনসন।
এরপর জনসনের জন্য কোন পথ খোলা?
এখন পর্যন্ত যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন তা বিবেচনায় নিয়ে সিএনএন বলছে, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য লড়ে যাবেন জনসন। মঙ্গলবার সকালে ডাউনিং স্ট্রিটের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, তিনি মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক ডেকেছেন এবং ‘ব্রিটিশ জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে যাওয়ার অঙ্গীকার জানিয়েছেন’।
জনসনের মন্ত্রিসভা ও দলের এমপিদের বেশিরভাগই তাকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য আস্থা ভোট সবসময়ই দুঃসংবাদ। আস্থা ভোট হওয়া মানেই দলের ভেতরকার অস্থিরতার বিষয়টি সামনে চলে আসা। আর ইতিহাসেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতারা আস্থা ভোটে উৎরে গেলেও তা প্রায়শই তার ক্ষমতার অবসানেরই সূচনা করে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে হাউজ অব কমন্সে দুই-তৃতীয়াংশ সহকর্মীর সমর্থন পাওয়ার পরও ছয় মাস পরেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এই ঘটনা নিশ্চয়ই এখনও জনসনের স্মৃতিতে টাটকা। আড়াই বছর আগে যে বরিস জনসন যে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই তাকেই এখন আস্থা ভোটে উৎরাতে প্রতিটি এমপি’র ভোট চাইতে হয়েছে।
এখন যদি দেখা যায় যে জনসনের রাজনৈতিক লোকসান এতটাই যে ওই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব না, সেক্ষেত্রে তিনি হয়ত সম্মান ধরে রেখে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পথ নিতে পারেন। আরেকটি পথ হচ্ছে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন আহ্বান করা। যদিও সোমবার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন এ ধরনের কোনো চেষ্টা তিনি করবেন না। সোমবার জনসন দলের নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ২০১৯ সালে তার নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির বিজয় ছিলো দলের ইতিহাসে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় জয়।
বিরোধীদের জন্য কী উপায়?
সোমবার বিরোধী দল লেবার পার্টির প্রধান কাইর স্টারমার এলবিসি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যে পথেই যাক না কেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তির সূচনা হয়ে গেছে সোমবারের আস্থা ভোটের মধ্যে দিয়ে। ভোট শেষে স্টারমার বলেন, “যে মহান কার্যালয়ের দায়িত্বে জনসন আছেন, তার জন্য পুরোপুরি অযোগ্য তিনি।” ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনগণকে অবজ্ঞা করার অভিযোগও তোলেন তিনি।
স্টারমার বলেন, “কনজারভেটিভ পার্টির সরকার এখন ভাবতে শুরু করবে যে আইনভঙ্গের সঙ্গে আইন প্রণয়নের কোন সম্পর্ক নেই।” সিএনএন লিখেছে, যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে জনসনই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি দায়িত্বে থাকার সময় আইনভঙ্গের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং জরিমানা গুণেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে আবারও আস্থা ভোট ডাকার পরিকল্পনা আছে কিনা- জানতে চাইলে মঙ্গলবার লেবার পার্টির উপপ্রধান অ্যানজেলা রায়নার বিবিসিকে জানান, তারা সব ধরনের উপায়ই বিবেচনায় রেখেছেন। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজেওন আস্থা ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী জনসনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সোমবার এক টুইটে তিনি জনসনকে ‘পুরোপুরি খোঁড়া হাঁস’ আখ্যা দিয়ে টোরিদের দুরবস্থা তুলে ধরেন।