সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নাটকীয়ভাবে রবিবার মস্কোতে পালানোর পর থেকে ইসরায়েল প্রতিবেশী দেশটির ওপর শত শত হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, এই হামলাগুলো তাদের প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। তবে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে একটি সিরীয় অস্ত্রবহরের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে দুজনকে হত্যার পর থেকে সিরিয়ায় অবাধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
তার পর থেকে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে এবং সাধারণত দাবি করেছে, তারা হিজবুল্লাহ ও ইরানের অবস্থান লক্ষ্য করে আঘাত করছে।
‘ধ্বংসের প্রতি ঝোঁক’
এদিকে গত কয়েক দিনে ইসরায়েল সিরিয়ায় ৪৮০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। পাশাপাশি তারা গোলানের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত সংঘাতমুক্ত অঞ্চলে (বাফার জোন) স্থলবাহিনী মোতায়েন করেছে। এ ছাড়াও তারা সেখানে একটি ‘নিরাপদ প্রতিরক্ষা অঞ্চল’ তৈরি করতে চায় বলে জানিয়েছে।
এ ছাড়া ইসরায়েল সোমবার ভূমধ্যসাগরের বাইদা ও লাতাকিয়া বন্দরে নোঙর করা ১৫টি জাহাজে আঘাত হানে, যা গোলানের উত্তর দিকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহির আল-শামের (এইচটিএস) দ্রুত অগ্রগতির অনেক কৃতিত্ব দাবি করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিরীয় শাসনের পতন আমাদের হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানের ওপর চালানো গুরুতর আঘাতের সরাসরি ফল।’
তবে সিরিয়ায় হামলা সম্পর্কে ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মাইরাভ জোনসেইন বলেছেন, এটি ‘দুইয়ের মিশ্রণ—সুযোগ ও কৌশল’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা যা দেখছি, তা হলো ইসরায়েলের ৭ অক্টোবর থেকে বিকাশমান কৌশল : একটি হুমকি বা সুযোগ চিহ্নিত করা, সেনা মোতায়েন করা এবং তারপর এটি কিভাবে সমাধান করা যায়, তা নির্ধারণ করা।’
অন্যদিকে কোনো কৌশল এখানে কার্যকর ছিল বলে রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ওরি গোল্ডবার্গ একমত নন। তার মতে, ‘এটি আমাদের নতুন নিরাপত্তা মতবাদ।
তিনি আরো বলেন, ‘লোকেরা বৃহত্তর ইসরায়েল সম্পর্কে এবং কিভাবে ইসরায়েল তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিস্তৃত করছে, তা নিয়ে কথা বলছেন। আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। আমি মনে করি, এটি মূলত বিশৃঙ্খলা ও নতুন বা ততটা নতুন নয়—এমন (ইসরায়েলি) ধ্বংসের প্রতি এক ঝোঁকের ফল।’
বিশ্বের সমালোচনাকে উপেক্ষা
ইসরায়েল গত ১৪ মাসে অন্তত ৪৮ হাজার ৮৩৩ জনকে হত্যা করেছে। তারা ইরান ও তার মিত্র হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছে, তারপর লেবাননে আক্রমণ করেছে এবং এখন সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলেও আক্রমণ করছে, যা বেশ কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে গণহত্যার সমতুল্য।
অন্যদিকে হতাহতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়ে নেতানিয়াহুর ‘মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলানোর’ বক্তব্য ইসরায়েলের অধিকাংশ গণমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে। দ্য জেরুজালেম পোস্টে মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি মতামতে বলা হয়েছে, ‘গত বছরে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্য জাতিসংঘ বা পশ্চিমা কূটনীতিকদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে।’
সিরিয়ার ওপর ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে মিসর, ফ্রান্স, ইরান, ইরাক, কাতার, রাশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। শনিবার ২২ সদস্যের আরব লীগ এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে ‘কাজে লাগানোর’ অভিযোগ করেছে। দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের এক কলামে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের গত ১৩ মাসের কার্যক্রম ‘একটি নতুন শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যপ্রাচ্যের’ দিকে ইঙ্গিত করছে।
জাতিসংঘও আন্তর্জাতিক আইনের এই লঙ্ঘন নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত সিরিয়া ও ইসরায়েল সীমান্তের বাফার জোনের তদারকি করার ম্যান্ডেট রয়েছে তাদের। ‘জাতিসংঘের প্রতিবাদগুলো কোনো কাজে আসবে না’ উল্লেখ করে গোল্ডবার্গ বলেন, ইসরায়েলের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষ দেশটির মধ্যে এক ধরনের মনোভাবের অংশ।
দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের কলাম লেখক জেফরি লেভিন বুধবার গত ১৩ মাসকে ‘একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হওয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে, গত বছরের মতো ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলোর পর সিরিয়া আল-আসাদ পরিবারের ভূরাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে, ইরান তার ‘ধর্মতান্ত্রিক শাসন’ থেকে মুক্ত হবে, কুর্দিরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে এবং ফিলিস্তিনিরা জর্দানে নতুন ‘স্বদেশ’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিমরড ফ্ল্যাশেনবার্গ বলেছেন, ‘আমি মনে করি না, অধিকাংশ ইসরায়েলি মানুষ এরপর তারা ওই অঞ্চলে জনপ্রিয় হবে বলে কল্পনা করে।’ যদিও সিরিয়ার কুর্দি ও দ্রুজ সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে সমঝোতা সম্ভব হতে পারে। তবে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি মনে করি, তারা এমন একটি মধ্যপ্রাচ্যের আশা করছে, যেখানে ইসরায়েলের প্রতি বিরোধী শাসন কম থাকবে।’