শিল্পী আক্তার: থানা পুলিশের সোর্সেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজধানীর মাদক ব্যবসা। পুলিশের পরোক্ষ সহযোগিতা থাকায় একরকম প্রকাশ্যে চলছে মাদক বিকিকিনি। পাড়া-মহল্লায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসা এখন জমজমাট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানার সোর্সেরা আসামি ধরার নামে পুলিশের সঙ্গে গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। যে কারণে সোর্সরূপী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মাদকের এখন ছড়াছড়ি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অপরাধী গ্রেফতারে নানা তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করাই সোর্সের কাজ। পুলিশ এসব সোর্স নিয়োগ করে অপরাধীদের মধ্য থেকেই। বিনিময়ে তারা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পায়। কিন্তু সোর্সেরা অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দিয়ে নিজেরাই ব্যবসা শুরু করছেন। এরা মাঝেমধ্যে বিরোধী গ্রুপের দু-চার জনকে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যবসা নিরাপদ রাখেন। ডিএমপির ৫০ থানার কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় রাজধানীজুড়ে মাদকের স্পট তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, খিলগাঁও, সবুজবাগ, দক্ষিনখান, বাড্ডা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকার সোর্সেরা সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। পুলিশের গাড়িতে চলাফেরার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মানুষ ভয়ে মুখ খোলে না। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে সাধারণত পুলিশের সোর্স প্রয়োজন হয়। এ জন্য পুলিশের নিয়মিত বাজেটের একটা বড় অংশ সোর্সমানি হিসেবে বরাদ্দ রয়েছে। তবে এ সোর্সমানির টাকা কখনো সোর্সদের দেওয়া হয় না। তারা এলাকায় পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা করেই তাদের পাওনা পুষিয়ে নেন। আর এ কারণে সোর্সেরা কখনো ওই টাকা দাবিও করেন না।
এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পুলিশের অন্তত ৫০০ সোর্স অপরাধে জড়িত, যাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড, চাঁদাবাজি, হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, এই দাগি সোর্সদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ আসছে। এর ভিত্তিতে তাদের পরিচয়সহ একটি তালিকা করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সব মহানগর পুলিশের কমিশনার ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে চিঠি পাঠিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর সোর্সদের লাগাম টানতে বলেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘পুলিশের সোর্সরা অনেক সময় নাম ভাঙিয়ে অনেক অপকর্ম করে। এটা বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। এ কারণে ম্যানুয়ালি সোর্সনির্ভরতা কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সোর্সদের সঙ্গে অপরাধ কর্মকান্ডে কোনো পুলিশ সদস্যদের নামে অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সাদাপোশাকের পুলিশের কার্যক্রমও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বনানী-গুলশানের মাদক ব্যবসার মহাজন পুলিশের সোর্স শহীদ। তার একটি মাদক চক্র রয়েছে। এ চক্রের সদস্যরা হলেন ভাগিনা হৃদয়, জাকির, নাডা সুমন, হারূন, ফটিক, স্বপন, মহরম ও মাইনুদ্দিন। এরা সবাই মাদক সেবক ও বিক্রেতা। প্রতিনিয়ত তারা গাঁজা, বিয়ার, ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর এদের তৎপরতা বাড়ে। রাতে গ্রাহকরা ভিড় করে সোর্স শহীদের বাসায়। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের ওপর নেমে আসছে নির্যাতনের খড়গ। এ ছাড়া চোর চক্রের সঙ্গে সোর্স শহীদ জড়িত বলে জানা গেছে। হিজড়াদের দিয়েও মাদক ব্যবসা করানোর অভিযোগ রয়েছে শহীদের বিরুদ্ধে। শহীদসহ তার গ্রুপের সবাই পুলিশের সোর্স হিসেবে ওই এলাকায় কাজ করছেন। পুলিশকে তারা নিয়মিত মাসহারা দিয়েই এসব কাজ করছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
আট বছর আগে রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশ হেফাজতে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনি (২৮) হত্যার মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অন্যতম আসামি পুলিশের সোর্স রাসেল ইসলামকে গত ৬ই মার্চ দুপুরে লালবাগ এলাকা থেকে মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়। রাসেলের দেহ তল্লাশি করে ৭৫ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, মাদকদ্রব্য বিক্রির সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এলাকার মাদক কারবারিদের কাছে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে আসছিল। তবে এ মামলার বাদী পুলিশ জানতেন না, গত ৮ বছর আগে পুলিশি নির্যাতনে গাড়িচালক জনি হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এই রাসেল।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, পল্লবী-১১ নম্বর সেকশনের ইরানি ক্যাম্পে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গাড়িচালক জনি ও তার ভাই রকিকে আটক করে পুলিশ। তাদের পল্লবী থানায় নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে পরদিন জনির মৃত্যু হয়। জনি হত্যার মামলায় ২০২০ সালে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় আসামি রাসেলকে। একই মামলায় পুলিশের এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল ও এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।