তবে আইনটি প্রণয়নের পর থেকে এটির প্রবল বিরোধিতা করে আসছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনার মামলায় নতুন আইনে শাস্তির মাত্রা ‘অযৌক্তিক’ বেশি। পরে তা সংশোধনের ইঙ্গিত আসে সরকারের পক্ষ থেকে। এবার তা সংশোধনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেল। এরপর তা আইন প্রণয়নের কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংসদে পাস করা হবে।
মাহবুব হোসেন বলেন, ২০১৮ সালে এই আইন করা হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর নেতৃত্বে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল এই আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা গুরুতর আহত হলে তা অজামিনযোগ্য অপরাধ হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত সংক্রান্ত অপরাধ করলে এত দিন দুই বছর জেল এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল, সেটিকে কমিয়ে দুই বছর জেল এবং তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। লাইসেন্স বাতিলের পরও যানবাহন চালালে বর্তমান আইনে তিন মাস কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল। তার বদলে তিন মাস কারাদণ্ড এবং ১৫ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া কন্ডাক্টরের দায়িত্ব পালন করলে এক মাস কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান বহাল রাখা হয়েছে। এই ধারায় এখন কন্ডাক্টরের সঙ্গে সুপারভাইজার শব্দটি যোগ করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, বর্তমানে আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা অজামিনযোগ্য। প্রস্তাবিত আইনে ৮৪ ও ৯৮ ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মোটরযান চালানোর ফলে দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের ক্ষেত্রে দণ্ডের কথা আছে। এই ধারায় মোটরযানের মালিককে বীমা করতে বলা হয়েছে। আর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত কোনো মোটরযানের কারিগরি নির্দেশ অমান্যের দণ্ডের কথা আছে ৮৪ ধারায়। আর ১০৫ ধারা এখনকার মতো অজামিনযোগ্যই থাকছে। দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির কথা আছে এই ধারায়। এতে বলা আছে, এই আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটলে, সেসংক্রান্ত অপরাধগুলো দণ্ডবিধিতে থাকা বিধান অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে শর্ত হিসেবে বলা আছে, দণ্ডবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতরভাবে আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা এবং লাইসেন্স বাতিল, প্রত্যাহার ও স্থগিত করার বিষয় আছে আইনের ১২ ধারায়। এই ধারার ৩ উপধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল করা হলে তিনি কোনো মোটরযান চালাতে পারবেন না। এটি লঙ্ঘনের জন্য এখন শাস্তি আছে তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। প্রস্তাবিত আইনে জরিমানা কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
৬৯ ধারায়ও সাজা কমানো হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত, প্রদান বা নবায়নে বিধি-নিষেধ রয়েছে। বর্তমানে এই ধারা লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর, তবে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা এবং কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। সেটি কমিয়ে এখন সাজার মেয়াদ দুই বছর রাখা হলেও অর্থদণ্ড কমিয়ে তিন লাখ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আইনের ১৪-এর বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কন্ডাক্টরের লাইসেন্স ছাড়া কোনো গণপরিবহনে এই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি তা করেন, তাহলে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে এখানে সাজা ঠিক রাখা হলেও সুপারভাইজারেরও কথা যুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে গণপরিবহনে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন করা এবং নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রয়েছে। এ ছাড়া চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষ সূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে। প্রস্তাবিত আইনে শাস্তি কমেনি। তবে এখন দুটি অপরাধ একত্রে করলে শাস্তি হয়। এখন আলাদা করে বলা হয়েছে, যদি ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন না করা হয় অথবা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করা হয়, তাহলে এই শাস্তি হবে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী ট্রাফিক সাইন ও সংকেত না মানলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হতো। এখন জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে দুই হাজার টাকা করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ওজন বহন করলে তিন বছর জেল এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হতো। এখন সেটির বদলে এক বছর জেল, এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এর সঙ্গে চালকের ১ পয়েন্ট কাটা যাবে। বর্তমান আইনে পরিবেশদূষণকারী মোটরযান চালালে তিন মাস জেল এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হতো। এটি কমিয়ে এক মাস জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মাহবুব হোসেন বলেন, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করালে বর্তমান আইনে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার সঙ্গে চালকের ১ পয়েন্ট কাটা হতো। এটির বদলে শুধু এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। খসড়ায় মোটরযান মালিককে বীমা করার একটি ধারা যোগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বীমা না করলে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
ইফতার পার্টি না করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ
রমজান মাসে ইফতার পার্টি না করে সেই অর্থ দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মাহবুব হোসেন বলেন, এর আগে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যারা ইফতার পার্টি করতে আগ্রহী বা যাদের সাধ্য আছে তারা যেন সাধ্য অনুযায়ী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ইফতার পার্টির যে টাকা সেটি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আরো দুটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমবায় নিয়ে একটি স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের আলোকে যাতে কৃষিভিত্তিক সমবায় গড়ে তোলা যায়, সে জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন। আট বিভাগে পর্যায়ক্রমে কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যাতে আমাদের বিভিন্ন কৃষিপণ্য অফ সিজনে দাম বেড়ে যায় বা সংরক্ষণের সুযোগ আমাদের কম থাকে, এ জন্য খুব আধুনিকতম সংরক্ষণাগার তৈরি করতে বলেছেন তিনি। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন চেম্বার থাকবে। যে পণ্যের জন্য যে ধরনের তাপমাত্রা মেইনটেন করতে হবে, সেটি মেইনটেন করে যাতে দীর্ঘ মেয়াদে এই পণ্যগুলো রেখে বাজারে এর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায় সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন।’ মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এগুলো মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ফলোআপ করব।’
রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনেছেন প্রধানমন্ত্রী
রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে কোন মন্ত্রণালয় কী করছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে সেই তথ্য নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, এ তথ্য জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, তিন মন্ত্রণালয় কী কী করেছে তা জানিয়েছে। যেমন—মৎস্য মন্ত্রণালয় থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাছ ও মাংস বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে বেশ কয়েকটি বড় কম্পানি ঢাকা শহরে এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য জায়গায় মিলগেটে যে রেট সেই রেটে তারা তাদের পণ্য বিক্রি করবে। মাঝখানে অনেক হাত হয়, সে জন্য মিলগেটে নিজ উদ্যোগে তেল, ডাল ও চিনি বিক্রি শুরু করেছে এবং এটির পয়েন্ট আরো বাড়বে বলে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (সংশোধন) আইন ২০২৪-এর খসড়া চূড়ান্ত, খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট (সংশোধন), হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট (সংশোধন) ও বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট (সংশোধন) আইন ২০২৪-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।