ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আঘাত আসবে, ষড়যন্ত্র হবে, কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাবে। সেটাই আমরা চাই। ’ তিনি গতকাল শনিবার দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে এ কথা বলেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
দলের জাতীয় সম্মেলনের বক্তব্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উসকানি না দেওয়ার আহবান জানান শেখ হাসিনা। এ সময় বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের অবদানের কথা তুলে ধরেন। সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা আগামী দিনে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আর পিছিয়ে যাবে না, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, জাতির পিতার স্বপ্ন ইনশাআল্লাহ আমরা পূরণ করব। ’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়েছি। আগে নির্বাচন কমিশনের কোনো আর্থিক সক্ষমতা ছিল না। সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কাছে রাখা ছিল, যেটা আমরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনের হাতে দিয়ে দিয়েছি। বাজেট থেকে সরাসরি তাদের টাকা দেওয়া হয়, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। ’
ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইভিএম করার পর আর কোনো ভোট জালিয়াতি করার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ পাস করেছি। আমাদের যদি জনগণের ভোট চুরির দুরভিসন্ধি থাকত তাহলে আমরা এই আইন কেন করলাম? খালেদা জিয়ার মতো ওই আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন আমরা করতে পারতাম। তা তো আমরা করিনি। কারণ আমাদের জনগণের ওপর আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমরা চলি। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতায় যেতে এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিলেন খালেদা জিয়া। বর্তমানে ভোটার আইডি স্মার্ট করা হয়েছে। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে ভোট চুরি করে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন। ভোট চুরি করলে জনগণ ছেড়ে দেয় না। বিএনপিকেও ছাড়েনি। তাদের ক্ষমতা থেকে টেনে নামায় জনগণ। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দেয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমি চার-চারবার প্রধানমন্ত্রী। আমাদের পরিবার দুর্নীতিই যদি করত, তাহলে দেশের মানুষকে আর কিছু দিতে পারত না। আমরা দেশের মানুষকে দিতে এসেছি। মানুষের জন্য করতে এসেছি। ’
সকাল সাড়ে ১০টায় শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এর আগে সম্মেলন মঞ্চে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পাশাপাশি জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’।
সম্মেলন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে শেখ হাসিনার আগে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, অভ্যর্থনা উপকমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। শোক প্রস্তাব পাঠের পর প্রয়াতদের স্মরণে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতাও পালন করেন।
সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনসহ ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
যুদ্ধে উসকানি বন্ধ করুন : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি একটা কথাই বলব, আমরা সব বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে আজকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে একটা বাধা এসেছিল করোনা, এরপর শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমার আহবান, আমরা ওই যুদ্ধ চাই না, নিষেধাজ্ঞা চাই না। ওগুলো বন্ধ করুন। সব দেশ স্বাধীন। স্বাধীনভাবে তার চলার অধিকার আছে। এই অধিকার সব দেশের থাকতে হবে। যুদ্ধ মানুষের ক্ষতি করে, যুদ্ধের ভয়াবহতা কী আমরা জানি। ’
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধে সবচেয়ে মেয়েরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় ওই যুদ্ধের সময়। এ জন্য যুদ্ধ চাই না। আমি বিশ্বনেতাদের কাছে আহবান জানাব—ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করুন। তাদের উসকানি দেওয়া বন্ধ করুন। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। কেবল কভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে আমরা বের হয়ে আসছিলাম। সেখানে এই যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা আমাদের সব অগ্রযাত্রা নষ্ট করছে। উন্নত দেশগুলোও আজ হিমশিম খাচ্ছে। কত ভাগ বিদ্যুতের দাম তারা বাড়িয়েছে? আমরা বাংলাদেশ এখনো ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সে জন্যই আমি সবাইকে আহবান জানিয়েছি, যার যেটুকু জমি আছে চাষ করুন বা উৎপাদন করুন। আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদেরটা নিজেরা খাব, কিন্তু করো কাছে হাত পেতে চলব না, যদিও আমাদের সম্পদ কম। ’ তিনি বলেন, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন দেশ উন্নত মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। তাই আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশের স্বার্থ নষ্ট হতে দেব না। ’
যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ায় আ. লীগ : আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠন জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কেননা এটাই আওয়ামী লীগ এবং এটাই আওয়ামী লীগের শিক্ষা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেমন সংগ্রামের ইতিহাস, আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগই পারে একটি দেশকে উন্নত করতে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে, যেভাবে এখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ যেদিন পেট ভইরা খাইতে পাইবে, যেদিন প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুটিবে, আওয়ামী লীগের সংগ্রাম সেই দিনই ক্ষান্ত হইবে। আজকে আওয়ামী লীগ এটুকু বলতে পারে—বাংলাদেশের কোনো মানুষ অভুক্ত থাকে না। ’
জাতির পিতার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পিতা, আমরা কথা দিলাম আপনার জনগণ কখনো অভুক্ত থাকবে না, আপনার জনগণ কষ্টে থাকবে না, আপনার যে আদর্শ আছে, সেই আদর্শ নিয়ে জনগণের পাশে থেকেই এই জনগণকে সুন্দর জীবন দেব, উন্নত জীবন দেব এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আর সেভাবেই এ দেশ পরিচালনা করব। ’ তিনি বলেন, ‘যত অশুভ শক্তি, যত আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করুক, বাঙালি এগিয়ে যাবে আগ্রযাত্রার পথে এবং জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করব। ’