ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার যত কৌশল আছে, তার সবগুলোই প্রয়োগ করেছেন সালমান এফ রহমান। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার নতুন নিয়ম তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করেছিলেন তিনি।
ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার ওপরে।
গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শেয়ারবাজার ও ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির মূলহোতাদের একজন হিসেবে গত ১৫ বছর ধরেই আলোচনায় ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ গ্রহণ ও সময়মতো পরিশোধ না করার পাশাপাশি কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়েছেন ৬ হাজার কোটি টাকা।
বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে গত মঙ্গলবার ৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের ৯৫০ শতাংশ। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক ঋণ গ্রহীতা সীমার অতিরিক্ত। সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক একক ঋণ সীমার নিয়ম প্রয়োগ না করায় ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি। জনতা থেকে নেওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের ৭২ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমানের ঋণ পরিশোধ না করার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৪ সালে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা এবং বেসরকারি ন্যাশনাল, এক্সিম ও এবি ব্যাংক থেকে নেওয়া ৫ হাজার কোটি টাকা নিজের ইচ্ছামতো সময়ে পরিশোধের আবদার করেন প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। ওই বছরের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে আবেদন করে ঋণ পরিশোধে ১২ বছর সময় চান। আড়াই বছরের জন্য কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত এবং সুদের হার কমিয়ে ১০ শতাংশ করার বিধান অনুমোদন করিয়ে নেন সালমান এফ রহমান।
২০১৪ সালে গভর্নরকে দেওয়া আবেদনপত্রে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ‘২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিনিষেধ, পূর্ববর্তী তিন বছরে ৮০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ এবং ২০১৩-১৪ সালে দীর্ঘ অবরোধ ও শাটডাউনের কারণে ঘটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে’ দায়ী করে ৫ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ঋণ জরুরি ভিত্তিতে পুনঃতফসিলের আবেদন করেছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি নতুন বড় ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালায় বলা হয়, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো মামলা করতে পারবে।
পরে নীতিমালার আওতায় ১২ বছর মেয়াদে ১০ শতাংশ সুদে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকোর ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করে সোনালী ব্যাংক। যা বাজার ভিত্তিক সুদের হারের চেয়ে অনেক কম। ওই সময়ে ঋণের সুদহার ছিল ১৩-১৪ শতাংশ। এ ছাড়াও এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সোনালী ব্যাংককে ৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল বেক্সিমকোর। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঋণগ্রহীতার ছয় কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেক্সিমকো দিয়েছে মাত্র দুটি কিস্তি। ফলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে খেলাপি হওয়ার পরেও সোনালী ব্যাংক প্রদত্ত সুবিধা বাতিল করেনি এবং বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে মামলাও করেনি। উল্টো ২০১৮ সালের মার্চে আবারও সালমান এফ রহমানের প্রভাবে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য খেলাপি ঋণের ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট করা বাধ্যতামূলক হলেও তখন বেক্সিমকোকে কোনো ডাউন পেমেন্ট করতে হয়নি। ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ার আরেকটি উদাহরণ হলো বেক্সিমকো গ্রুপের জিএমজি এয়ারলাইনসের ঋণ। ২০০৯ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইনসের অর্ধেক শেয়ার কিনে নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। এই কোম্পানির ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৬ সালের আগস্টে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ভাই গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমানের সম্পত্তি নিলামে তোলার উদ্যোগ নেয় সোনালী ব্যাংক।
পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেই নিলাম আটকে যায়। এ বছর জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার নোটিস দিলে জিএমজি হাই কোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেয়। বছরের পর বছর ধরে গ্রাউন্ডেড থাকা বিমান সংস্থাটিও আদালতের আদেশের কারণে তার অ্যাকাউন্টগুলো নিয়মিত রাখা হয়েছে।