রিয়াদ থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে আল খারজ এলাকার মরুভূমিতে অবস্থিত সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ও সুপরিচিত আলমারাই কোম্পানির ডেইরী ফার্ম। সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে এ কোম্পানির আরও কয়েকটি ডেইরী ও পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে। কোম্পানির আমন্ত্রণে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে গত ১৮ জুন আমরা রওনা দেই ফার্মটি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন তাঁরা প্রায় সকলেই এ কোম্পানির পণ্য সম্পর্কে কমবেশি জানেন। কারণ আলমারাই কোম্পানির দুধ, দই, লাবানসহ অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য সৌদি আরবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া এ কোম্পানির বিভিন্ন প্রকার জুস স্বাদে, গুনে-মানে  বাজারের সেরা বলে সবাই তাদের পণ্যের ব্যাপারে আস্থা রাখেন। এছাড়া প্রতিবছর পবিত্র হজ ও ওমরা পালনের জন্য যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি সৌদি আরব আসেন তাঁরাও সবাই কমবেশি আলমারাই কোম্পানীর পন্যের সাথে পরিচিত। 

আমরা রিয়াদের ডিপ্লোম্যাটিক কোয়ার্টারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সকাল ৮ টার দিকে রওনা দিয়ে প্রায় ১০টার দিকে আলমারাই ফার্মের গেটে এসে পৌঁছালাম। এখানে আসার পর কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের স্বাগত জানান। কোম্পানির এসিস্ট্যান্ট ফার্ম ম্যানেজার মি. লি আমাদের স্বাগত জানান। আমাদের গায়ে এ্যপ্রোন পরিয়ে স্যানিটাইজ করে একটি মিনিবাসে তুলে ফার্মের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় পঞ্চাশোর্ধ ফিলিপাইনী মি. লি কে দেখলে মনে হয় ত্রিশ বছরের যুবক। এনিম্যাল সাইন্সে স্নাতক লি সৌদি আরবে কাজ করছেন প্রায় ত্রিশ বছর। লি আমাদের জানান, আলমারাই কোম্পানির বেশ কয়েকটি ডেইরী ফার্ম সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে, তাঁর মধ্যে আল খারজ এর এ ফার্মে গরুর সংখ্যা ৩৫ হাজার। যেখান থেকে প্রায় ১৯ হাজার গরু প্রতিদিন গড়ে ৪২ লিটার দুধ প্রদান করে, দিনশেষে প্রায় ৭ লক্ষ ৮২ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয় এ ফার্ম থেকে। এ ফার্মে আমেরিকার হলস্টেইন জাতের গরু রয়েছে, যাঁদের আর্টিফিশিয়াল ইনসিমনেসন এর মাধ্যমে গর্ভধারণ করানো হয় ১৪ মাস বয়সে। তারপর বাছুর আসার পর শুরু হয় দুধ দেয়া, প্রতিদিন চারবার দুধ সংগ্রহ করা হয়। দুধ দেয়া শুরু হলে গরুগুলো প্রায় ৬-৮ বছর একটানা দুধ দিতে থাকে। বাছুরগুলো সেভাবে মায়ের দুধ খাবার সুযোগই পায়না, কারন বাছুরগুলো জন্মের কিছু সময় পরই আলাদা করে ফেলা হয় এবং তাদের দেয়া হয় নিউজিল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ গুড়ো দুধ, যাতে বাছুরগুলো তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে। এ সময় বাছুরদের শিং তুলে ফেলা হয়, যাতে বড় হয়ে শিং এর আঘাতে অন্যান্য গরু আহত না হয়।  

দুধ দেয়া গরুগুলোকে আলাদা করে রাখা হয়, যেন প্রতিদিন খুব সহজেই চার বার দুধ সংগ্রহ করা যায়। তাদের শেড এর নিচে থাকে বিশেষ শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যাতে বাইরে তাপমাত্রা বাড়লেও ভিতরের তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রীর মধ্যেই থাকে। তাদের খেতে দেয়া বিশেষভাবে তৈরি খাবারের মিশ্রণ যাতে পর্যাপ্ত খাদ্যমান বজায় থাকে। এছাড়া প্রচুর পানিও খেতে দেয়া যেন দুধের উৎপাদন অব্যহত থাকে। প্রতিদিন চারবার নির্দিষ্ট সময়ে দুধ সংগ্রহ করা হয়, এক্ষেত্রে সময় খুব যথাযথভাবে মেনে চলা হয়। কারন দুধ সংগ্রহে দেরি হলে গরুগুলো যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকে। 

 

প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ ফার্মের ৩৫ হাজার গরুর জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হয় কয়েক টন খাবার। সৌদি আরবের হাইলে আলমারাই কোম্পানির গরুর জন্য ঘাস উৎপাদনের ফার্ম রয়েছে। এসব গরুদের দেয়া হয় আলফা আলফা জাতের ঘাস। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসসহ কয়েক জায়গায় কোম্পানির জমি কেনা রয়েছে, যেখানে ঘাস উৎপাদন করে সৌদি আরব পাঠানো হয়। 

গরুর দুধ সংগ্রহ ও তা ধাপে ধাপে বিশুদ্ধ করে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেয় পাশেই স্থাপিত সম্পূর্ণ অটোম্যাটিক কারখানায়। ডেইরী ফার্ম পরিদর্শন শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় এ অত্যাধুনিক কারখানায়। এখানে কারখানার প্রশাসনের প্রধান আলী আল কাহতানি আমাদের স্বাগত জানান। বাইরে তখন তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ছুই ছুই। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। এখানে আমাদের আলমারাইর বিভিন্ন প্রকার জুস ও দুগ্ধজাত খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। যা অনেকটা অমৃত এর মতই লাগছিল খেতে।  

এ কারখানায় স্বয়ংক্রিয় মেশিনে পাস্তুরিত করে বোতলজাত করা হয় দুধ, এছাড়া দুধ থেকে উৎপাদন করা হয় দই ও লাবান। দুগ্ধজাত অন্যান্য পণ্য যথা পনির, ক্রিম, বিভিন্ন প্রকার ফ্ল্যাভারড দুধ, ফ্ল্যাভারড লাবান ও দই তরি করে এ কোম্পানি যা বাজারে দামে সস্তা, খেতে সুস্বাদু ও মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

সৌদি আরব ছাড়া আরব আমিরাত, জর্ডান ও মিশরে রয়েছে আলমারাই কোম্পানির ফ্যাক্টরি। যেখানে তাদের বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি হয়। এ কোম্পানির রয়েছে বিশাল সরবরাহ ব্যবস্থা, যার জন্য রয়েছে প্রায় ৮ হাজার রেফ্রিজারেটেড ট্রাক, যাতে সারা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ও তাদের পণ্য দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দেয়া যায়। কারন এ সকল পণ্য দ্রুত পচনশীল, তাই গ্রাহকদের কাছে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। 

প্রিন্স সুলতান বিন মোহাম্মদ বিন সউদ আল কবির এর উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে মাত্র ৩৫০টি গরু দিয়ে শুরু হওয়া এ কোম্পানির বিভিন্ন ফার্মে এখন গরুর সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ নব্বই হাজার। যেখান থেকে প্রায় প্রতিদিন ৪ মিলিয়ন লিটার এর বেশি দুধ সংগ্রহ করা হয়। 

ডেইরী প্রোডাক্ট ছাড়া ও আলমারাই কোম্পানির রয়েছে বিভিন্ন প্রকার উন্নতমানের জুস, বেকারি ও পোল্ট্রি পণ্য। যা মান ও গুনের দিক থেকে অত্যন্ত ভালো। এছাড়া ভবিষ্যতে গরুর মাংস উৎপাদন ও মাছ নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আলমারাই কোম্পানীর রয়েছে বলে জানান মি. কাহতানি। আলমারাই কোম্পানি বছরে ১২ বিলিয়নের ও বেশি পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া এদের পোলট্রি বিভাগের রয়েছে ২০০ মিলিয়ন চিকেন উৎপাদনের ক্ষমতা।

এসময় রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী আলমারাই কোম্পানির ডেইরী ফার্ম ও কারখানা পরিদর্শন আয়োজন করার জন্য কোম্পানির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ কোম্পানিতে বর্তমানে প্রায় ১,১০০ বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছে। আগামী দিনে এ কোম্পানিতে আরও বেশি বাংলাদেশি অভিবাসীর কর্মসংস্থান হবে বলে রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন। কারখানা পরিদর্শন শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় তাদের গেস্টহাউজে, যেখানে পরিবেশন করা হয় নানা পদের সুস্বাদ সৌদি খাবার, সাথে দেয়া হয় আলমারাই কোম্পানির নানা রকম জুস, ফ্ল্যাভারড দই ও লাবান। 

রিয়াদে ফিরে আসার সময় তীব্র গরমের তাপ টের পেলাম, বাইরে তখনও প্রায় ৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রা, শুধু গাড়িতে উঠার সময় যেটুকু রোদ গায়ে লেগেছিল তাতেই কিছুক্ষণ মাথা ঝিম ঝিম করছিল। শনিবার দিনটি সবার বেশ ভালো কাটল। মরুর দেশে একটি সফল ডেইরী ফার্ম এর ব্যবস্থাপনা ও এর সফলতা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম।