উচ্চশিক্ষিত পাত্র-পাত্রীর জন্য অনেক সময় উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। অভিভাবকেরা ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে পরিবার চায় তার ছেলেকে সুন্দরী, ফরসা, শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করাতে, যার মধ্যে বাংলাদেশি কালচার রয়েছে। আবার কোনো কোনো ছেলে চান উচ্চশিক্ষার্থী, মেধাবী, কর্মরত পাত্রী বিয়ে করতে। বাবা-মায়ের পছন্দের সাথে অনেক সময় পাত্র-পাত্রীর পছন্দের মিল হচ্ছে না। ফলে উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত পাত্র-পাত্রী মেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আবার কেউ কেউ এমন আছেন, নিজের সন্তানকে এখানে বড় করলেও বিয়ে দিতে চান বাংলাদেশে নিয়ে অথবা বাংলাদেশ থেকে এখানে নতুন এসেছেন এমন স্টুডেন্ট পাত্রের সাথে। বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আগামী দিনে সংসারের কর্তৃত্ব কে নেবেন, সেটা বাবা-মা নির্ধারণ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন, দেশে নিয়ে ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিলে ছেলের বউ কিংবা মেয়ের জামাই কথা শুনবে। অ্যাডজাস্ট করতে সমস্যা হবে না। সব দিক থেকে সুবিধা হবে। আগে এটি অনেক বেশি সংখ্যায় হতো। বর্তমানে এই প্রবণতা কিছুটা কমেছে। কারণ এখানে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা এবং লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েরা এখন দেশে গিয়ে বিয়ে করার চেয়ে এখানেই বিয়ে করতে চাইছেন। কারণ তারা মনে করেন, এখানে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের সমমনা। কোনো কোনো পাত্র-পাত্রী আছেন, তারা জন্মসূত্রে আমেরিকান ছাড়া বিয়ে করতে রাজি নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবক ও পাত্র-পাত্রীদের মধ্যে নিজের পছন্দের বাইরে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই। এসব কারণে সব সময় পছন্দসই পাত্র-পাত্রী মিলছে না। এ ছাড়া দেশে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি প্যান্ডামিকের পরে কিছুটা কমেছে। কারণ, প্যান্ডামিকের কারণে ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার জন্য যারা আবেদন করছেন কিংবা দেশে বিয়ে করা স্ত্রী কিংবা স্বামীকে এখানে নিয়ে আসতে চাইছেন, তাদের ভিসা পেতে সময় লাগছে। এ কারণে ছেলে কিংবা মেয়েকে বিয়ে করানোর পর তার জীবনসঙ্গীকে মাসের পর মাস দেশে থাকা ও বছরের পর বছর অপেক্ষা করা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে অভিভাবকেরা একটু ভয় পাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জ্যামাইকায় বসবাসরত এক বাংলাদেশি বলেন, আমার দেখা একটি ছেলেকে তার বাবা-মা দেশে নিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন তার বউ এখানে আসতে পারছে না। আবেদন করেছে কিন্তু ব্যাকলগের কারণে বউয়ের আসতে সময় লাগছে। এ কারণে এখন ছেলে সব সময় অস্থির থাকছে। বউকে রেখে তার জন্য এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সে অফিস থেকে কয়েক দফা ছুটি নিয়ে দেশেও গেছে। এভাবে বারবার দেশে যাওয়ার কারণে তার অফিসের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। ফলে অফিস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তার নজরে এনেছে। তিনি বলেন, ওই ছেলে যদি এখানে বিয়ে করত, তাহলে তাকে অন্তত স্ত্রীকে ছেড়ে থাকার কষ্ট করতে হতো না। তাকে সব সময় অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হতো না, বরং স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকতে পারত। আর চাকরিটাও মনোযোগ দিয়ে করতে পারত।
একজন অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ফার্মাস্টিট। আমরা ফার্মাসিস্ট কিংবা অন্য বিষয়ের পাত্র হলেও বিবেচনা করতে চাই, দেশে পাত্র হলেও চলবে। অন্য স্টেটে হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ে কোনোভাবেই দেশে বিয়ে করতে রাজি নয়। অন্য স্টেটেও যেতে রাজি নয়। সে মনে করে, নিউইয়র্ক ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানে বেড়ে উঠেছে, এমন ছেলেই চাই। কিন্তু মেলাতে পারছি না। এখন পাত্র খুঁজছি।
একজন পিএইচডি হোল্ডার পাত্রীর বাবা তার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন। কিন্তু পছন্দসই পাত্র পাচ্ছেন না। এর কারণ, তারা পিএইচডি কিংবা এর সমমানের পাত্র চান। কিন্তু সমমানের পিএইচডি পাত্র পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পরিচিতজনদের মাধ্যমে পাত্র না পেয়ে তারা অন্যান্য উপায়ে পাত্র খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে আরেকজন অভিভাবক তার উচ্চশিক্ষিত ছেলের জন্য পাত্র খুঁজছেন। তিনি বলেন, তিনি চান তার ছেলের জন্য শিক্ষিত ভালো মেয়ে। প্রতিষ্ঠিত মেয়ে। তার স্ত্রী চান ছেলের জন্য সুন্দরী ও ফরসা মেয়ে। ছেলের সুনির্দিষ্ট পছন্দ নেই। তারা একটি স্টেটে থাকেন, যেখানে তাদের অত পরিচিত বাংলাদেশি নেই। তারা নিজস্ব নেটওয়ার্কের পাত্রী পাননি। বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, পাত্রী মিলছে না।
এদিকে একজন ডাক্তার পাত্রের জন্য পাত্রী খুঁজছেন পাত্রের এক আত্মীয়। পাত্রী খুঁজতে গিয়ে ডাক্তারের জন্য ডাক্তার পাত্রীর বায়োডাটাই বেশি পাওয়া গেছে। অনেক বায়োডাটা কিন্তু তাদের ডাক্তার পাত্রী চাই না। কারণ তারা মনে করছেন, দুজন ডাক্তার হলে সংসার চালানো কঠিন হবে। এই চিন্তা করে ডাক্তার পাত্রী নয়, অন্য পাত্রী চান তারা।
একজন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য পাত্র খুঁজছেন বাবা-মা। এ নিয়ে তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু পছন্দসই পাত্রী মেলাতে পারেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশির ভাগ পাত্রের বাবা-মা এবং পাত্র সবাই চান সুন্দরী, ফরসা, লম্বা পাত্রী। এটাই তাদের পছন্দের পাত্রীর মূল যোগ্যতা ধরেন। শিক্ষা, ভালো মানুষ, ভালো মনের মানুষ, শিক্ষিত পরিবার, সম্ভ্রান্তÍ পরিবার এগুলো পাত্রী খোঁজার সময় মুখে বললেও পরে শেষমেশ তারা সুন্দরী, ফরসা, লম্বা পাত্রীর বাইরে বের হতে পারেন না। ফলে অনেক সময় অনেক ভালো, শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত পাত্রী পাওয়ার পরও তারা হাতছাড়া করেন।
আরও দেখা গেছে, কিছু পরিবার আছে, যারা পাত্র বিয়ে দিতে গিয়ে সুন্দরী, ফরসা, লম্বা পাত্রীর পাশাপাশি বাংলাদেশে তার নিজ জেলার মেয়েই খোঁজেন। তারা মনে করেন, নিজ জেলার মেয়ে না হলে কালচারে মিলবে না। আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে পারবে না। আঞ্চলিক বিষয়টি প্রাধান্য দিতে গিয়ে পাত্রী-পাত্র পেতে সময় লাগে। তারা ভদ্র, ভালো, লম্বা, সুন্দরী, শিক্ষিত, চাকরিজীবী, শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে খোঁজেন আবার সংসারী মেয়ে হতে হবে। পাত্রের বেলায়ও একজনের ভেতরে সব যোগ্যতা চান।
আবার এমন চিত্রও রয়েছে, বাবা-মা ছেলের লেখাপড়া শেষ করার পর বিয়ে দিতে চান কিন্তু ছেলে বিয়ে করতে চান না। আবার বাবা-মায়ের সাথেও থাকতে চান না। পারিবারিক জীবনের বন্ধনের বাইরে বের হয়ে তিনি তার মতো করে চাকরি করে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে চান। এভাবে অনেক ছেলেই লেখাপড়া শেষ করে বাবা-মাকে ছেড়ে নিজের মতো করে চাকরি নিয়ে আলাদা থাকছেন। কেউবা একই সিটিতে থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে থাকছেন নিজ কর্মস্থলের পাশে। কিন্তু একই শহরে থাকলেও তাদের বাবা-মায়ের সাথে প্রতিদিন দেখা হয় না। কথাও হয় না। আবার কেউ কেউ থাকেন সিটির বাইরে। কেউবা পরিবারকে ছেড়ে পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরি নিয়ে চলে যান অন্য স্টেটে।
এ ছাড়া বিভিন্ন কারণেই উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়েদের জন্য সমমানের পাত্র-পাত্রী মেলানো কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে, মেয়েদের জন্য। অনেক অভিভাবক নিজের ও মেয়ের পছন্দসই পাত্র না পাওয়ায় মেয়েকে বিয়ে দিতে না পেরে দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন।