যুক্তরাষ্ট্র হাইজ অফ রেপ্রেজেন্টেটিভের বাংলাদেশ ককাস সদস্য কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেং-এর সঙ্গে গত ৮ই ডিসেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশী সংখ্যালঘু সমাজের নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্ক শহরের ফ্রেস মিডোজে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা ডক্টর দিলীপ নাথের বাসভবনে এক ঘন্টার অধিক স্থায়ী এ সভায় উপস্থাপক ও আলোচক অধ্যাপক নবেন্দু দত্ত, রূপকুমার ভৌমিক, ডক্টর দিলীপ নাথ, ভজন সরকার, ভবতোষ মিত্র, প্রণবেন্দু চক্রবর্তি, সুশীল সিনহা, ও ডক্টর দ্বিজেন ভট্টাচার্য বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে নিরন্তরভাবে অব্যাহত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারা করছে, তাদের উদ্দেশ্য কী, এই সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ করতে এ’ যাবৎ কোন সরকারের কী ভূমিকা ছিল সে’সব বিষয়ে কংগ্রেসওম্যানকে সম্যক অবহিত করে তাঁর হাতে তাঁদের বক্তব্যের পরিপূরক মিডিয়া রিপোর্ট ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র তুলে দিয়ে, আসন্ন নির্বাচনকালে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তা ছাড়াও ১৯৭১-এর গণহত্যার পটভুমি, সেকুলার ডেমোক্র্যাটিক বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুর্ভোগের অনুপুঙ্খ কাহিনী, দেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও রাজনীতে ধর্মীয় উগ্রপন্থী-মৌলবাদীদের পুনর্বাসন, এবং সাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ধর্ম করে, জন্মগতভাবে সেকুলার ডেমোক্র্যাটিক বাংলাদেশকে কার্যত: একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা, অত্যাচারের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ায় দেশের মোট জনসংখ্যায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্বের হার ও সংখ্যা অবিশ্বাস্য পরিমানে হ্রাস পাওয়ার কারণও এবং তার ফলে বাংলদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে আর যে মাত্র তিরিশ বছর লাগবে সে’সম্পর্কে ঢাকা ট্রিবিউনে ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান-নির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেংকে জানানো হয়।
বক্তারা কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেংকে বলেন যে, তাঁদের মত প্রধানত: দুই কারণে আজ বাংলাদেশে সেকুলার ডেমোক্র্যাসি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিপন্ন। প্রথমটি হচ্ছে সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বি. এন. পি.’র রাজনৈতিক আঁতাত ও মোর্চা গঠন; আর দ্বিতীয়টি হল সংখ্যালঘু নির্যাতক ঐসব ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও মৌলবাদীদের তোষণ করার জন্য তাদের কখনও বিচারের আওতায় না আনা।
বক্তারা অনারেবল কংগ্রেসওম্যানকে বলেন যে, বি. এন. পি. সংবিধান লঙ্ঘন পূর্বক একাত্তরের গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহনকারী জামাত-এ- ইসলামীর মত যুদ্দাপরাধী ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট বেঁধেছে, এবং এক কালের সেকুলার ডেমোক্র্যাট আওয়ামী লীগ তার প্রগতিশীল চরিত্র বিসর্জন দিয়ে ধর্ম-নিরপেক্ষ গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘু নাগরিকদের সম-নাগরিক অধিকার ও অস্তিত্বের বিনিময়ে হেফাজত-এ-ইসলাম সহ কয়েকটি মৌলবাদী দলের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করেছে। তাঁরা আরও বলেন যে, বিএনপি-জামাত-এ-ইসলামীর কর্মীরা তো নিজেরাই সামপ্রদায়িক নির্যাতন করে, তাদের সরকার এমনকি পেরামিলিটারি ফোর্স পাঠিয়ে লোগাং ম্যাসাকারের মত সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসও করেছে, যাতে ঐ গ্রামের ৬০০ আদিবাসীকে হত্যা করার পর গোটা গ্রামটিতে অগ্নি সংযোগ করে নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছিল (সেই সময় ১৭ জন কংগেসম্যান কর্তৃক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এ’ বিষয়ে গভীর উৎকন্ঠা প্রকাশ করে লেখা কংগ্রেশন্যাল চিঠির কপি কংগ্রেসওম্যানের হাতে তুলে দেওয়া হয়)।
“প্রগতিশীল দল” বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ যদিও বিএনপি-এর মত নিজেরা কিংবা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কখনও সংখ্যালঘু নির্যাতন করেনি, তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ করার কোন টেকসই ব্যবস্থাও গ্রহন করেনি; সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ধর্মীয় মৌলবাদীদের তোষণ করতে দু’ চারটে বহুল প্রচারিত কেইস ছাড়া তাঁরা কোন সংখ্যালঘু নির্যাতকের বিচার করেনি। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, এবং তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে বি. এন. পি., বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোন তফাৎ নেই, যার উদাহরণ হিশেবে তারা শত্রু সম্পত্তি আইনের বলে সম্পত্তি অত্মস্যাৎ করার পরিসংখ্যান এবং এবং বর্তমানে শুধু মুসলমানদের জন্য ৫৬০ টি মডেল উপাসনালয় নির্মানের ব্যাপারটা উল্লেখ করেন। ২০০১ -২০০৬ সালের মধ্যে প্রধানত: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বি. এন. পি ও জামাত-এ-ইসলামী জোট যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল সে’সব ঘটনার তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্ট, যাতে সনাক্তকৃত কয়েক হাজার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী অপরাধীর মধ্যে সরাসরি বিচারযোগ্য ২৬০০ অপরাধীর নাম রয়েছে, যা ২০১১ সালে জজ্ সাহাবুদ্দীন কমিশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কছে হস্তান্তর করেছিল, তাদেরও কারও বিচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখনও করেনি, যা সন্ত্রাসীদের সহিংসতার মাধমে দেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নে উৎসাহ যোগাচ্ছে বলেও তারা দাবি করেন। বক্তারা বলেন যে, প্রগতিশীল দল বলে দাবিদার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই দু:খজনক ভূমিকার ফলে, ২০১২ সালে রামুতে পচিশ হাজারের অধিক মৌলবাদীর বৌদ্ধদের ওপর বর্বর আক্রমণের পর থেকে একের পর এক অসংখ্য অত্যাচরের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চাইলেই ঠেকাতে পারত।
বক্তারা একের পর এক সকলে আসন্ন নির্বাচনকালে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলে, কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেং এর কারণ জানতে চান। তখন বক্তারা ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত পর এক রাতে বি. এন. পি -জামাত-এ-ইসলামীর সদস্যরা যে চর-ফেশনে এক রাতে একটি স্পটে ২০০ হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে নির্বাচনী বিজয়োল্লাস করেছিল, সেই সময় ধর্ষিতা নারীর ৯৮% যে সংখালঘু সম্প্রদায়ের ছিল, এবং তৎপরবর্তি সময়ে দেশের সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ করে, লুটপাট করে, দেব-দেবীর মূর্তি ও উপাসনালয় গুড়িয়ে দিয়ে, পাশবিক অত্যাচার ও হত্যা করে তাঁদের পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেঢ়ে শূন্য হাতে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল সে’সবের বর্ণনা করে তার সপক্ষে দলিলপত্র কংগ্রেসওম্যানের হাতে তুলে দেন। নেতৃবৃন্দ অনারেবল কংগ্রেসওম্যানকে বলেন যে, অগ্রীম ব্যবস্থা গ্রহন না করলে ঐ ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে, কারণ বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু শূন্য করে দ্রুত দেশাটাকে আরেকটি আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত করা যাদের ঘোষিত লক্ষ্য তারা সুযোগ পেলেই সেটা করবে। এটা করতে তারা বিন্দু মাত্র দ্বিধা করবে না, কারণ সন্ত্রাসীরা জানে যে কোন রাজনৈতিক দলই অতীতে যেমন এই অপরাধের জন্য তাদের বিচার করেনি তেমনি ভবিষ্যতেও করবে না। ব্যাপরটা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা অনারেবল কংগ্রেসওম্যানকে বোঝানোর জন্য একজন বক্তা ওনাকে তৎকালীন সময়ের কয়েকটি মিডিয়া রিপোর্ট পড়ে শোনান, যার মধ্যে দুটোর শিরোনাম: ”Bangladesh’s religious minorities: safe only in the departure lounge.”(The Economist, Nov. 29, 2003), এবং “Rape and torture empties the villages,” The Guardian, July 21, 2003. বক্তারা বলেন যে, এ’ ধরণের ভয়াবহ পরিস্তিতি ঠেকানোর জন্য ইলেকশন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেনা বহিনীর তিন প্রধান, গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিনের ডি. জি., পুলিশের আই. জি, বি. জি. বি. প্রধান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের সমন্বিত প্রস্ততি দরকার।
নেতৃবৃন্দ বলেন যে, দেশে চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে অনেক আগেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিৎ ছিল, এবং মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে (এর কপি কংগ্রেসওম্যানকে হস্তান্তর করা হয়) একটি ”সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন” পাশ করবেন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, কিন্ত তিনি স্বেচ্ছাকৃতভাবেই তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেতার অব্যবহিত পরই যদি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ “সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন” পাশ করত তা’হলে ২০২১ সালের শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লান নানুয়ার দিঘীর পাড় থেকে শুর করে ২২টি জেল্যা জুড়ে যে সামপ্রদায়িক সহিংসতার নারকীয় তাণ্ডব হয়ে গেল সেটা হ’ত না, আজ দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদেরকে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও উৎকণ্ঠায় থাকতে হ’ত না। বক্তারা উল্লেখ করেন যে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীসভায় এখনও বিভিন্ন বিল পাশ হচ্ছে, এবং ওনার কাছে তাঁদের দাবি তিনি যেন আর বিলম্ব না করে “সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন” পাশ করে দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করা। বক্তারা কংগ্রেসওম্যানের হাতে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদকৃত “সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের” একটি খসড়া বিল, যা তাঁরা রাষ্ট্রদূত ইমরান সাহেবেরে মাধ্যমে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনেক আগেই পাঠিয়েছিলেন, তুলে দিয়ে বলেন যে তা’তে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য যেসব আইন আছে, সেগুলোই রয়েছে – নতুন কিছু নেই। তাঁরা দাবি করেন যে, সরকার চাইলেই দেশে সংখ্যলঘু নির্যাতন চিরতরে বন্ধ হতে পারে যেমনি বন্ধ হয়েছে, এ্যসিড সন্ত্রাস – বিচার ও শাস্তির ভয় থাকলে কেউ সংখ্যালঘু বিরোধী সন্ত্রাসে লিপ্ত হতে দু:সাহস করবে না।
সবকিছু শুনে এবং দেখে কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেং বলেন যে, তিনি অন্তরিকভাবে চান যে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি ফ্রী অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন হোক যাতে সংখ্যালঘু নাগরিকগণ সহ দেশের সকল নাগরিক নিরাপদে অংশ গ্রহন করতে পারে। তিনি আরও বলেন যে, সংখ্যালঘু নাগরিকদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য, এবং যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টিকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করে। নির্বাচনকালে তো বটেই, সংখ্যালঘু নির্যাতন সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে তিনি মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশে ককাসের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও আশ্বাস দেন।
সব শেষে, কংগ্রেসওম্যান গ্রেইস মেং বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তাপস দে, সুবল দেবনাথ, পরিমল কর্মকার, সাধন দাস, গোপাল সাহা, নৃপতি রায় সহ উপস্থিত সকলে তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দেশের প্রগতিশীল শক্তিকে সাহায্য করতে অনুরোধ জানান যাতে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান, অর্থাৎ ধর্ম-রিনপেক্ষ গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়।