নিউইয়র্ক: নিউইয়র্কে উৎসবমুখর পরিবেশে গত শুক্রবার শুরু চার দিনের ‘নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা’র নাম পরিবর্তন করে ‘নিউইয়র্ক বাংলা আন্তর্জাতিক বইমেলা’র ঘোষণা দেওয়া হলো। 

‘ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বাঙালি এই মেলায় অংশগ্রহণ করায় তার ব্যাপ্তি বিস্তৃত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী, তাই এটিকে আন্তর্জাতিক বইমেলা নামকরণে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। বিপুল করতালির মধ্যে উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে এই ঘোষণা দেন প্রথমে বইমেলার আহ্বায়ক বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুন নূর এবং এরপরই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবী। এভাবেই সামনের বছর ৩৩তম বইমেলার নামকরণ হলো ‘নিউইয়র্ক বাংলা আন্তর্জাতিক বইমেলা’। 

জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্ট সেন্টারের নির্মল আনন্দদায়ক পরিবেশে বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা রহমানকে পাশে নিয়ে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ফিতা কেটে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় মেলা কমিটির সকল কর্মকর্তা সেখানে ছিলেন। এরপর মিলনায়তনের ভেতরের মূলমঞ্চে উঠার সময় ৩২ বছরের মেলার মূলপর্বের আগে ৩২ জন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক-লেখক-প্রকাশককে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় এবং তারা প্রদীপ প্রজ্বলন করেন।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. সিতারা রহমান বইমেলার প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমি এখানে এসে এতো আনন্দিত, খুশি এবং গর্বিত। মনে হচ্ছে যে, আমার বীর প্রতিক খেতাব পাওয়াটা বোধহয় স্বার্থকই হয়েছে। কারণ, এখানে এত বাঙালি-বাংলাদেশ, কলকাতা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রিলিয়া থেকে এসেছেন, সবারই একটি পরিচয়, তা হচ্ছে বাঙালি।’

বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি ইন্তেকাল করার পর ডা. সিতারা হচ্ছেন জীবিত একমাত্র বীর প্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা। ৭৮ বছর বয়স চলছে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হলেও মনোবল হারাননি। তবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না বলে চেয়ারে বসে বক্তব্য প্রদানের জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। 

বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা থেকে তিনি দেশ ও প্রবাসের লেখক-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-কবি-চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার সকলের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য। যারা যুদ্ধ করেছেন, রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিপক্ব মানুষ ছিলেন, তারা যেন সঠিক ইতিহাস লিখেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা রটেছে যার অনেকটাই সত্য নয়। আসল কথা বলতে গেলে মুস্কিল হয়ে যায়। আমি বলব যারা আসল খবর, আসল ইতিহাস জানেন, তারা যেন নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার স্বার্থেই তা লিখতে এগিয়ে আসেন।’ 

শুভেচ্ছা বক্তব্যে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বইমেলা শব্দটি আমার কাছে মনে হয় এটি একটি প্রবেশদ্বার, এটি বইয়ের জগতকে আপনার সামনে উম্মুক্ত করে দেয়। যখনই কেউ বইয়ের জগতে প্রবেশ করেন তখনই তার কল্পনাজগত এবং সৃজনশীলতার জগতে প্রবেশ করেন। যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এবং নিজের সম্ভাবনাগুলোকে নতুন করে আবিষ্কারের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। আর এমন একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে বহুজাতিক এ সমাজে।’ 

মনিরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশের লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে যারা এই প্রবাসে স্থায়ীভাবে বাস করছেন তাদের সেই সত্ত্বা অটুট রেখে বাঙালি সংস্কৃতির ফল্গুধারা নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের চমৎকার একটি পরিবেশ তৈরি করেছে এই বইমেলা। একইসাথে আমি আরো মনে করছি, যারা বাংলাদেশে থাকতে লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন না, তাদেরও একটি অংশ এই প্রবাসে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং উৎসাহবোধ করছেন গত ৩২ বছরের এই মেলা থেকে। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, আবেগ, যে অনুভূতি তা প্রকাশ করার জন্য অনেকে লেখছেন অথবা উদ্যোগী হয়েছেন। তাই এই বইমেলা শুধু বই পড়ার জন্যই নয়, নতুন লেখক সৃষ্টিতেও অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘একইভাবে এই প্রবাসে যারা বড় হয়েছেন, যারা এই সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, আলোকিত হয়েছেন, তাদের মধ্যেও কিন্তু বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বাঙালির ইতিহাস নতুনভাবে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এই বইমেলা।’ 

কন্সাল জেনারেল বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যকার বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তাকে আরো বলিষ্ঠ, বেগবান এবং গভীর করার কাজটিও করছে এই বইমেলা। তাই আমি প্রত্যাশা রাখছি যে, এই বইমেলার মধ্য দিয়ে আমরা সংকল্প গ্রহণ করি, আমরা জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়তে চাই, জাতি গঠন করতে চাই, যেখানে কোনো মারামারি-হানাহানি থাকবে না, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করে যাবো।’ 

লেখক-সাংবাদিক শামিম আল আমিন এবং উর্বি হাই’র উপস্থাপনায় এ পর্বে আরো বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, আবৃত্তি শিল্পী আহকাম উল্লাহ, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার এ জেড এম সাজ্জাদ হোসেন, কলকাতা বইমেলার সভাপতি সুধাংশ শেখর দে, সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

এর আগে প্রদীপ প্রজ্বলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ‘মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার’র প্রবর্তক, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পপতি গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবিদুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহউদ্দিন আহমেদ, লেখক-সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস, লেখক ফেরদৌস সাজেদীন, জসীম মল্লিক, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি বিশ্বজিৎ সাহা প্রমুখ। 

এবারের বইমেলায় দেশ ও প্রবাসের ২৫টি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও শতাধিক লেখক-সাহিত্যিক-কবি-প্রাবন্ধিক এসেছেন। নতুন বইয়ের সংখ্যা দুই হাজার বলে আয়োজকরা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ, কলকাতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা শিল্পীরা বিভিন্ন পর্বে অংশ নেবেন। রয়েছে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণে ‘শিশু-কিশোর যুব উৎসব’।