যখন বন্যা হয় তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে কিন্তু তাদের স্থায়ী সমাধান মেলে না। তারা চায় তাদের এখানে বাঁধ বানানো হোক। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক।
রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশ্যাম গ্রামের কৃষক সোলেমান আলী (৬০) জানান, বন্যার কারণে গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এটি যেকোনো সময় তিস্তাগর্ভে চলে যেতে পারে। ক্লিনিকটির চারদিকে বন্যার পানি থাকায় তাঁরা ক্লিনিকে যেতে পারছেন না।
কুড়িগ্রামের তিনটি উপজেলার চারটি ইউনিয়নে গত দুই দিনে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এখন পানি নেমে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমন ও শাক-সবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, তিস্তাপারে বন্যা পরিস্থিতিতে আমনের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে মঙ্গলবারের মধ্যে পানি নেমে না গেলে আগাম শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষতি হবে।
তিস্তা নদীবেষ্টিত রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও পাওটানার প্রায় ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ রাস্তাঘাটে দেখা দিয়েছে ভাঙন।
তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে উজানের ঢলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে তিস্তা। বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজম খাঁ, হযরত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুসমারা, চর রাজীব, গোপিঙ্গা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুরসহ চরাঞ্চলে ভাঙন দেখা দিয়েছে কিছু স্থানে।
গদাই গ্রামের শফিকুল, শাহিন ও গফফার জানান, দুই সপ্তাহ ধরে তিস্তা নদীর পানি কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। এরই মধ্যে অনেক বাড়িঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে তাঁরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বহুদিন ধরে মহাপরিকল্পনার কথা শুনে এলেও আজ পর্যন্ত কাজ শুরু না হওয়ায় তাঁরা হতাশ। চরগনাই গ্রামে ১০টি বাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে।
গতকাল সোমবার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহিদুল হক বলেন, ‘তিস্তা নদী এলাকায় বন্যা ও ভাঙনের বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি। উপজেলা প্রশাসন ও ত্রাণ বিভাগ বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত।
পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে বীজ বাদামসহ মরিচ ও আমন ক্ষেত। স্থানীয় কৃষক ও উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পানির নিচে থাকায় শতাধিক হেক্টর জমির বীজ বাদামের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
ভাঙনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
নীলফামারীর ডালিয়া পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, উজানের ঢল আর বর্ষণে তিস্তায় পানির প্রবাহ বেড়েছে। ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের খিতাব খাঁ, চর খিতাব খাঁ, গতিয়াশ্যাম, চর গতিয়াশ্যামসহ সাত-আটটি গ্রামে নদীভাঙনে ৪০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই দিনে শুধু চর গতিয়াশ্যামে ৩০টি পরিবার ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরো শতাধিক পরিবার। চর গতিয়াশ্যাম বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙনের মুখে পড়ায় মঙ্গলবার (আজ) তা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলে এলাকাবাসী জানায়।
তিস্তার তীব্র স্রোতে তীরবর্তী কয়েক শ একর উঠতি আমন ক্ষেত বিনষ্ট হয়েছে। কৃষকররা কাঁচা ধান কেটে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানিয়েছেন, বরাদ্দ না থাকায় কৃষিজমি রক্ষায় তাঁদের করণীয় কিছুই নেই। তবে স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তাঁরা জিও ব্যাগ ফেলে রক্ষার চেষ্টা করছেন।
লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে গতকাল পানি নেমে গেছে। তবে বিভিন্ন ফসলের অনেক ক্ষেত এখনো ডুবে আছে।
চাষিরা জানিয়েছেন, চরের জমিতে লাগানো আমনসহ বিভিন্ন ফসল কোথাও বালুতে ঢেকে গেছে, কোথাওবা পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে। কৃষি বিভাগের মতে, জেলার ৮৩৩ হেক্টর রোপা আমন এবং ৪৫ হেক্টর শাক-সবজির ক্ষেত এখনো পানিতে তলিয়ে আছে।
এদিকে লালমনিরহাট সদর ও আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার গোকুণ্ডা ইউনিয়নের গরিবুল্লাহপাড়া ও হরিণচড়া এলাকার অনেক ফসলের ক্ষেত নদীগর্ভে বিলীন। গতকাল ওই এলাকার অন্তত ছয়টি বসতবাড়িও বিলীন হয়ে গেছে।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, তাঁর ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেরশ্বর ও পূর্বছাতনাই গ্রামের এক হাজার ২০০ পরিবার এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনে প্রায় ২০০ বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
একই উপজেলার খালিশা চাপনী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, দুই দিনে বাইশপুকুর গ্রামের প্রায় ১৫ বিঘা আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭০০ পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। বুধবার এসব পরিবারে ত্রাণের চাল বিতরণ করা হবে।
নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান জানান, এখন বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। ব্যারাজের সব কটি জলকপাট (৪৪) খুলে রাখা হয়েছে।