খবর প্রকাশিত: ০৯ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৬:১১ পিএম
অন্য জেলা হতে আসা জেলেদের অবাধে জাটকা নিধনের ফলে মাছ মিলছে না ফেনীর জেলেদের জালে। প্রতিবাদ করতে গেলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সোনাগাজীর উপকূলীয় এলাকার জেলেদের এমন অভিযোগ আজও দূর হয়নি।
স্থানীয় জেলেদের দেওয়া তথ্য মতে, বড় ফেনী নদীর মোহনায় অর্থাৎ সন্দ্বীপ চ্যানেলে নিয়মিত মাছ ধরতে আসে সন্দ্বীপ, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালীসহ দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার এ পেশার মানুষ। এসব জেলেরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছে। বঙ্গোপসাগর হতে ফেনী নদী হয়ে সীমানায় মাছ চলাচলে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অসংখ্য কারেন্ট জাল ব্যবহার। ফলে ফেনী অংশে কমছে মাছের পরিমাণ।
এ প্রসঙ্গে আবছার নামে স্থানীয় একজন মাছ ধরার ট্রলার মালিক অভিযোগ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোহনায় নিয়মিত ২৫০ থেকে ৩০০ মাছ ধরার নৌকা রয়েছে। যারা অবাধে কারেন্ট জাল ব্যবহার করছে। এক একটি নৌকায় দৈর্ঘ্যে ৩ কিলোমিটারের বেশি কারেন্ট জাল রয়েছে। এ জালের বহর ৪০ থেকে ৬০ ফুট। সে হিসেবে স্বন্দীপ চ্যানেলের এ অংশে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কারেন্ট জাল নির্বিঘ্নে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে একশ গ্রাম ওজনের একটি মাছও এ জালকে ফাঁকি দিতে পারে না।
তিনি বলেন, ফেনীর জেলেরা সুতার জাল ব্যবহার করে থাকে, নিষিদ্ধ কোনো জাল ফেনীর জেলেরা ব্যবহার করে না।
শফিক নামে স্থানীয় এক মৎস্য আড়ৎদার বলেন, ফেনী উপকূলে এখন মাছের পরিমাণ কমে গেছে। এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০টি নৌকা মাছ ধরতে যাচ্ছে। যেখানে পূর্বে এর দ্বিগুণ ছিল। একটি নৌকা তিনদিনের জন্য বের হলে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। মাছ ধরার মৌসুম শেষে যোগ বিয়োগ করলে আয় ব্যয়ের হিসাব মেলে না। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। জেলেদের প্রণোদনা হিসেবে সরকারের চাল এখন অন্য পেশার লোকরাও পাচ্ছে।
রবীন্দ্র কুমার জলদাস নামে স্থানীয় এক জেলে জানান, আয় কমে যাওয়ায় তিনি এখন নদীতে মাছ ধরতে যান না।
উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সোনাগাজীতে তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা ১ হাজার ৬২৪ জন। তাদের মধ্যে ইলিশ মাছ ধরেন এমন জেলের সংখ্যা ২৫০ জন। তবে স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ সংখ্যা বর্তমানে ১০০ থেকে ১৫০ জনে নেমে এসেছে।
জেলে পাড়ায় ৮৫টি পরিবার বাস করে বলে জানান আরেক জেলে কৃষ্ণধন সর্দার। যেখানে মোট সদস্য সংখ্যা সাড়ে ৫ শতাধিক। তিনি জানান, এখানে মাছ ধরার বড় ইঞ্জিন নৌকা রয়েছে ১০টি। এছাড়া ছোট নৌকা রয়েছে ৭০টি।
ফেনীর জেলেদের মাছ ধরার সরঞ্জাম ও সামর্থ্য প্রসঙ্গে স্থানীয় নুর আলম জানান, এখানকার জেলেরা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। বড় কোনো মাছ ধরার নৌকা নেই। ফলে ফেনী নদীর মোহনা এবং নদী এলাকাতে মূলত মাছ আহরণ করে থাকে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সুযোগ থাকলেও সক্ষমতা না থাকায় তা সম্ভব হয় না।
মাছ আহরণের পরিমাণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আলী আফসার জানান, দুই বছর আগেও বড় নৌকাগুলোতে প্রতিবার বর্ষার মৌসুমে দশ লাখ টাকারও বেশি মাছ ধরা যেত। গত বছর তা তিন লাখ টাকায় নেমে আসে। এতে মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয়ও নির্বাহ সম্ভব হয় না। তাই আমি আমার সকল নৌকা বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।
জাটকা মাছ ধরা বন্ধ করা না গেলে ফেনী অঞ্চলের জেলেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে এমন আশঙ্কা করেছেন স্থানীয় জেলেরা। সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কার্যালয় হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, সোনাগাজী উপকূলে প্রাপ্ত ইলিশ মাছের ওজন সাধারণত ৬শ হতে ৮শ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ উপকূলে আহরণকৃত ইলিশের পরিমাণ ৭৯ দশমিক ২৮ টন। তবে গত অর্থবছরে আহরিত সব ধরনের মাছের পরিমাণ ছিল ২৭০ টন।
কারেন্ট জাল ব্যবহার করে নির্বিচারে মাছ নিধনের অভিযোগ ইতোপূর্বে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন। তিনি জানান, যে স্থানে কারেন্ট জাল অবাধ ব্যবহারের অভিযোগ আসছে তা ফেনী জেলার অন্তর্গত নয়। ফলে অভিযোগ সত্য হলেও আমাদের তাৎক্ষণিক কিছু করার থাকে না। তবে এ বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়েছে। জেলেরা এমন অভিযোগ ইতোপূর্বে আমাকে করেছে। সীমানাজনিত কিছু প্রতিবন্ধকতা এখানে রয়েছে। তবে আমরা সহসা অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করছি।
বড় ফেনীর নদীর মোহনায় কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ নিধন বন্ধে উপকূল রক্ষী বাহিনীর (কোস্টগার্ড) সহায়তা চেয়েছেন জেলা মৎস্য অফিস ও জেলা প্রশাসন। এমন তথ্য নিশ্চিত করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, ফেনী সীমানার বাইরে হওয়ায় সরাসরি আমাদের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। এ বিষয়টি ফেনীর বিদায়ী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসানের কাছে উপস্থাপন করা হলে তিনি ডিসি সম্মেলনে তুলে ধরেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে গত মাসে চট্টগ্রাম হতে কোস্টগার্ডের একটি প্রতিনিধি দল ফেনী উপকূল পরিদর্শন করে গেছেন। কোস্টগার্ডের অস্থায়ী ক্যাম্প যদি স্থাপন করা যায় তবে এ নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে।