রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরিনী ইউনিয়ন। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ইউনিয়নে ফুটবল দিন দিন পাচ্ছে জনপ্রিয়তা। আর সেই জনপ্রিয়তা আসছে এখানকার ফুটবলকন্যাদের হাত ধরে। এক অজপাড়াগাঁ থেকে জাতীয় নারী ফুটবল দলসহ অনূর্ধ্বভিত্তিক দল ও বিভিন্ন ক্লাবে রয়েছে এখানকার ফুটবলকন্যাদের সুনাম। দেশ-বিদেশে ভালো খেলে নজরে এসেছেন তারা। নিজেদের পরিচয় মেলে ধরার স্বপ্ন অর্জনে বরবরই রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

এবার সেই অর্জনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলার অদম্য মেয়েরা। সাবিনা-সানজিদাদের ওই দলে সাড়া ফেলেছে সদ্যপুষ্কুরিনীর জয়রাম গ্রামের সিরাত জাহান স্বপ্না। লাল-সবুজে গা মোড়ানো ‌‘নাম্বার টেন’ জার্সি পরিহিত স্বপ্না এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। তার ক্রীড়া নৈপুন্যে আনন্দে উদ্বেলিত পুরো বাংলাদেশ। স্বপ্নার জন্য এখন প্রসংশার রঙিন রঙে আবেগ আপ্লুত পুরোগ্রাম। কয়েক বছর আগেও যারা মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেখে ‘জাত গেল জাত গেল’ বলে নাক ছিটকেছেন, এখন তারাই গাইছেন স্বপ্নার মতো ফুটবলকন্যাদের জয়গান।

বুধবার নেপাল থেকে বিজয় শিরোপা নিয়ে দেশে ফিরবেন স্বপ্নারা। ছাদ খোলা বাসে নতুন ইতিহাসের চ্যাম্পিয়ন ট্রফি দুহাতে নিয়ে স্বপ্নাদের উৎসব দেখার অপেক্ষায় পুরো দেশ। কারণ সাবিনা-সানজিদা-স্বপ্নারা গর্বিত করেছেন জাতিকে, ভাসিয়েছেন আনন্দে। ভারতকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ভুটানের সাথে গোলবন্যার উৎসবের পর থেকে আনন্দের রেশ থামেনি স্বপ্নার গ্রামেও। এখন হাসছে গোটা এলাকা মানুষ। চলছে মিষ্টিমুখ করার ধুম।

রংপুরের হাট-বাজারে সবার আলোচনায় এখন ফুটবলকন্যাদের বিজয় গাঁথা গল্পের উপাখ্যান। পালিচড়া নয়াপুকুর হাটে কথা হয় শেরেফুল ইসলাম নামে এক যুবকের সাথে। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে শেরেফুল বলেন, আমাদের গ্রামে মেয়ে স্বপ্না নেপালের সঙ্গে বেশিক্ষণ খেলতে পারেনি। তারপরও মাঠে যে সময়টুকো খেলেছে, তা ছিল আন্তর্জাতিকমানের খেলোয়াড়দের মতো। আমরা অভিভূত তার নৈপুণ্য দেখে। এমন খেলা এবং এই বিজয়ের জন্য আমরা গর্ববোধ করছি।

সেখানকার মনছুর আলী নামে একজন ক্রীড়ানুরাগী বলেন, আমাদের খুবই ভালো লাগছে। খেলা দেখার পর বুকটা আনন্দে ভরে গেছে। এতো সুন্দর খেলা আগে দেখেনি। এরজন্য প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী যদি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্ট চালু না করত, আজ আমরা স্বপ্নাদের মতো খেলোয়াড়দের পেতাম না। এই মেয়েরাই এখন আমাদের দেশের গর্ব। এরা দেশ-বিদেশে খেলে দেশের এবং আমাদের রংপুরের সুনাম বয়ে এনেছে।

একই গ্রামের আরেক যুবক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিশ্বাস স্বপ্নার মতো আরো খেলোয়াড় এই গ্রাম থেকে বের হবে। যারা জাতীয় দলের হয়ে দেশের সুমান কুড়াবে। স্বপ্নারা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়ে থাকবে না, এদের দিয়েই আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো দেশগুলোকে হারানো সম্ভব হবে, যদি সরকারের পৃষ্টপোষকতা অব্যাহত থাকে।

সিরাত জাহান স্বপ্না রংপুরের গর্ব। খেলাকে কতটা ভালোবাসলে এমন খেলা সম্ভব! তার খেলা নিয়ে গ্রামের মানুষ নানান সময়ে নানান কথা বলেছে, সেইসব কথা সহ্য করতে না পেরে তার পরিবার একসময় খেলা বন্ধ করে দেয়। তখন সবেমাত্র ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিল স্বপ্না। সময়টা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন। তারপর স্কুল শিক্ষক বাড়িতে গিয়ে স্বপ্নার বাবা-মাকে বোঝাতে থাকেন স্বপ্না ভালো করবে। প্রত্যন্ত গ্রামের বর্গাচাষী বাবার মেধাবী মেয়ে স্বপ্নাকে এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।