২৯ ডিসেম্বর ২০২২, বাংলাদেশে তখন মধ্যরাত। কনকনে শীতের রাতে অধিকাংশ মানুষই তখন ঘুমে মগ্ন। সে রাতে হঠাৎই খবর আসে, না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি পেলে। ফুটবল বিশ্বকে শুন্যতায় ভাসিয়ে ৮২ বছর বয়সে ভিন্নলোকে যাত্রা করেছিলেন এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো।
মাঠ থেকে তাঁর বিদায়ি আয়োজনে মুখোমুখি হয়েছিল সান্তোস আর কসমস।
ফুটবল পায়ে তাঁর কারুকাজ এত প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল যে অহর্নিশ কুর্নিশ করে যাওয়াতেও দ্বিধা করতেন না কেউ। তবে মানুষ যেহেতু, কিছু ভুলত্রুটিও মাঝেমধ্যেই তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসত। তাই বলে ফুটবলার পেলের মর্যাদায় তা প্রভাব ফেলতে পারেনি একটুও।
প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই যে নামের সঙ্গে পরিচয় এই দূর বাংলাদেশেরও অজস্র মানুষের—এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। এটিও কারো অজানা নয় যে ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের নামের একাংশ তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন বাবা দোনদিনহো। যিনি নিজেও ছিলেন ফ্লুমিনেন্সের স্ট্রাইকার। লড়াকু মানসিকতার জন্য সতীর্থরা যাঁকে ডাকতেন ‘যোদ্ধা’ বলে। পেলের ডাকনামের সঙ্গেও ছিল এর যোগসূত্র, ‘ডিকো’ মানে ‘যোদ্ধার পুত্র’। কিন্তু দোনদিনহোর প্রথম সন্তান ভুল উচ্চারণের ফাঁদে পড়ে ডিকো থেকে অমরত্বের চূড়ায় উঠলেন কিনা পেলে নামেই! ভাস্কো দা গামা দলের গোলরক্ষক বিলে ছিলেন তাঁর প্রিয় খেলোয়াড়। কিন্তু কিছুতেই সেই নামটি তাঁর মুখে আসত না, বলে ফেলতেন পিলে। স্কুলের সতীর্থদের তাঁকে খেপানোর শুরু সেই থেকেই। তাদের মুখে মুখেই পেয়ে যান পেলে নামটি। প্রথম প্রথম রেগে যেতেন খুব। একবার এক সতীর্থের মুখে সপাটে ঘুষিও বসিয়ে দেন। নিজেই একসময় নামটি গ্রহণ করে নেন, যখন জানলেন, ‘হিব্রু ভাষায় পেলে মানে অলৌকিক কিছু। এক গবেষক সেটি বের করেন এবং আমাকে জানান। আর এই শব্দটি বাইবেলেও আছে।’
ধর্মগ্রন্থের শব্দটিই একসময় ফুটবল নামের ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। পেলে হয়ে ওঠেন এই ধর্মের সবচেয়ে বড় প্রচারকও। অথচ সেই শৈশব থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইও ফুটবলপ্রেমে বাধা হতে পারেনি। ফাভেলা বা বস্তির জীবনে পাইলট হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন একসময়। তবে বাড়ির কাছাকাছি একবার বিমান দুর্ঘটনায় পাইলটসহ সবার নিহত হওয়ার ঘটনায় সেই স্বপ্ন বিসর্জনে যায়। আবার আর্থিক টানাটানির পরিবারে সত্যিকারের ফুটবলও জোটে না। মোজার ভেতরে কাগজ ভরে দড়ি দিয়ে বেঁধে বানানো গোলাকার বস্তুই হয়ে উঠেছিল পেলের অমরত্বের পথে উত্থানের প্রথম গোলক। তাতে ক্রমাগত লাথি মারতে মারতেই একদিন দেখেন বাবা রেডিও কমেন্ট্রি শুনতে শুনতে কাঁদছেন। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে ব্রাজিলের যে হার ইতিহাসে মারাকানাজো বা মারাকানা বিপর্যয় হিসেবে স্থায়ী হয়ে আছে, সেদিনই দোনদিনহোকে কাঁদতে দেখে পেলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘কেঁদো না বাবা, আমি তোমাকে বিশ্বকাপ এনে দেব।’ তখন পেলের বয়স ১০ বছর পুরো হতেও তিন মাস বাকি। কে জানত যে আট বছরের মাথায়ই সুইডেনে বিশ্বজয়ের উত্সবের মধ্যমণি হবেন পেলে! ১৯৫৮ সালে সতীর্থরা কাঁধে তুলে নেবেন ১৭ বছরের কিশোরকে! এরপর আসে বিশ্বজয়ের ১৯৬২ আর ১৯৭০। তাতে বিলে থেকে পেলে হয়ে অমরত্বের এপিটাফে অক্ষয়ও হয়ে যান।