ঢাকা: এবার ঈদে ঢাকা ছাড়তে পারে প্রায় এক কোটি মানুষ। দেশের বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী রয়েছে অন্তত ২০ লাখ। তারাও ঈদে নিজ নিজ এলাকায় ফিরবে। এর বাইরে কাছে-দূরে তথা এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, জেলা-উপজেলা শহর থেকে গ্রামে বা দূরের শহরে যাতায়াত করবে আরো প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। সব মিলিয়ে এবারের ঈদ ঘিরে পাঁচ দিনে প্রায় ছয় কোটি মানুষ নানা গন্তব্য থেকে ঘরমুখো হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ রেলওয়ে, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ১৬ থেকে আগামী ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদ বাজার, গ্রামের বাড়ি যাতায়াতসহ নানা কারণে দেশের বিভিন্ন শ্রেণির পরিবহন প্রায় ৯০ কোটি ট্রিপে যাত্রী পরিবহন করবে। এর মধ্যে রিকশাও যুক্ত আছে।

ঢাকা থেকে গতকাল সোমবার ট্রেনে ঈদ যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে যাত্রী চলাচলের মূল চাপ আগামী বুধবার থেকে শুরু হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর হিসাব অনুযায়ী, বাসে ৪০ লাখ, লঞ্চে ২৭ লাখ, ট্রেনে ১০ লাখ, ভাড়া করা ও নিজস্ব মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়িতে ৩০ লাখ এবং বিমানে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়বে। আর ঈদের আগের দিন বা ঈদের দিন ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন ছোট যান, পিকআপ ও ট্রাকে করেও মানুষ ঘরে ফিরবে।

চট্টগ্রাম শহরে কর্মরত সাত লাখ মানুষ বিভিন্ন জেলায় ঈদ করতে যাবে। এর মধ্যে ট্রেনে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষ চট্টগ্রাম ছাড়বে। সেই হিসাবে পাঁচ দিনে এক লাখ মানুষ ট্রেনে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে। সঙ্গে যুক্ত হবে বাস, লঞ্চসহ অন্যান্য যানবাহন।

চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব গোলাম রসুল বাবুল জানান, আগামীকাল (আজ) মঙ্গলবার থেকে বাসে কোনো সিট খালি নেই। এবার ঈদে সড়কপথে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ি যেতে পারে।

একইভাবে রাজশাহী শহর ছাড়বে প্রায় চার লাখ মানুষ। যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার। বাকি তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষ রাজশাহীর অস্থায়ী বাসিন্দা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী রয়েছেন।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রফিকুল আলম বলেন, এই শহরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস করে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ শহর ছাড়বে। এখানকার মানুষও যাবে বাস, ট্রেন ও বিমানে। এরই মধ্যে অনেকে রাজশাহী ছাড়তে শুরু করেছে।

সিলেটের পরিবহন মালিক সমিতি সূত্র বলেছে, ঈদের পাঁচ দিন নিয়মিত তিন হাজার বাসে যাত্রী পরিবহন হবে। প্রতি বাসে গড়ে ৪০ জন যাত্রী হলেও দিনে এক লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হবে। তাতে পাঁচ দিনে ছয় লাখ মানুষ শুধু বাসেই সিলেট ছাড়বে।

ট্রেনও সিলেট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। এখানকার মানুষ বিভাগের ভেতরে যাতায়াতেও ট্রেন ব্যবহারে অভ্যস্ত। আর আছে ভাড়া ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রচলন।   

ময়মনসিংহ মহানগর ছাড়বে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। এদের বড় অংশই কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী। জেলা ও আশপাশের প্রচুর পরিমাণ শিক্ষার্থী এই শহরে থেকে লেখাপড়া করেন।

জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, ময়মনসিংহ নগরীতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাঁরা সবাই ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবেন। শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার লোক এখানে বেশি। আর বিভাগীয় শহর হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে এখানে চাকরি করে। ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দারা যারা নগরীতে বসবাস করে তারাও ঈদে বাড়িতে যাবে।

সবচেয়ে বেশি মানুষ যাবে ঢাকা থেকে : ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি ভালো আছে। ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে সব কিছু প্রস্তুত করা হচ্ছে। আনফিট বাস যেন ঢাকা থেকে রিজার্ভে যেতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

যদিও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ফিটনেসবিহীন বাস ঈদের সময় কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে রং করে সড়কে নামবে এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঈদের আগে পাঁচ-সাত দিনের প্রস্তুতিতে এর চেয়ে ভালো কিছু আশাও করা যায় না। তিনি বলেন, কয়েক দিনে প্রায় কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়বে। অথচ বিআরটিসির উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই।

রাজধানী থেকে দূরপাল্লায় প্রায় আট হাজার বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বলেছে, এবার ঈদে ঢাকা থেকে প্রায় ১০ হাজার বাস চলাচল করবে। গড়ে প্রতিটি বাস দিনে দুই ট্রিপ দেবে। প্রতি বাস গড়ে ৪০ জন যাত্রী পরিবহন করবে। সে হিসাবে দিনে গড়ে আট লাখ, পাঁচ দিনে ৪০ লাখ মানুষ বাসে ঢাকা ছাড়বে।

এসব যাত্রীর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক। অনেক কারখানার শ্রমিক নিজেরাই বাস ভাড়া করবে। যদিও এবার আনফিট বাস রিজার্ভ করে ঢাকার বাইরে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

নৌপথে ৩০ লাখ : ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নৌপথে উপকূলীয় এলাকায় যাবে। এর মধ্যে দিনে গড়ে তিন লাখ করে ৯ দিনে অন্তত ২৭ লাখ মানুষ সদরঘাট হয়ে যাবে। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির ঈদপূর্ব পর্যবেক্ষণ ও জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়।

সংগঠনটির প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়, প্রতি ঈদুল ফিতরে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে যায়। তাদের মধ্যে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার যায় নৌপথে। এর প্রায় শতভাগই উপকূলীয় জেলা বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের যাত্রী।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর চাঁদপুর ছাড়া অন্য জেলাগুলোর নৌযাত্রীর হার প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে; যা মোট ঈদযাত্রীর ৫ শতাংশ। এই হিসাবে এবার ঈদে নৌপথে যাবে ৩০ লাখ মানুষ।

মোটরসাইকেল, মাইক্রো, প্রাইভেট কারে ৩০ লাখ : যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ঈদ ঘিরে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে ১০ লাখ ট্রিপ হবে। এ ছাড়া মাইক্রোবাস, মিনিবাস ও বিভিন্ন অফিসের গাড়িতে প্রতিদিন চার লাখ করে পাঁচ দিনে ২০ লাখ যাত্রী ঢাকা ছাড়বে। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়িও যুক্ত হবে।

সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন জাতীয় মহাসড়কে সার্ভিস লেন না থাকায় আন্ত জেলা পর্যায়ে ঈদে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে ১৫ লাখের বেশি ইজি বাইক, রিকশা, অটোরিকশা সড়কে নামতে পারে। এসব ছোট যানবাহন মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহনের গতি কমিয়ে যানজট তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেবে।

রেলের যাত্রী ১০ লাখ : রেলের ঈদ যাত্রায় এবার শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। ঢাকা থেকে আন্ত নগর ট্রেনে প্রতিদিন যাত্রী পরিবহনের আসন রয়েছে ২৫ হজার ৭৭৮টি। এ ছাড়া ৯ জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে। আন্ত নগর, লোকাল ও কমিউটার মিলিয়ে ঢাকা থেকে প্রতিদিন আসনে পরিবহন করা যাবে ৫০ হাজার যাত্রী। সেই হিসাবে পাঁচ দিনে আড়াই লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। তবে এর সঙ্গে আরো প্রায় আড়াই লাখ মানুষ দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্র বলেছে, স্বাভাবিক সময় সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করে। ঈদের সময় এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ঈদের আগের পাঁচ দিনে ১০ লাখ মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করবে।

বিমানে ঢাকা ছাড়বে ৩০ হাজার মানুষ : অভ্যন্তরীণ রুটে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস, এয়ার এস্ট্রা ও নভো এয়ার যাত্রী পরিবহন করে থাকে। বিমান সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ঈদের আগের পাঁচ দিনে এসব বিমানে ৩০ হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহন করা হবে। সাতটি রুটে প্রতিদিন গড়ে ৩৫টি ফ্লাইট ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে। প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ৭৫টি করে আসন আছে।

পিকআপ-ট্রাকেও যাবে মানুষ : শুধু বাস, লঞ্চ, ট্রেন, মোটরসাইকেল বা মাইক্রোতেই সরাসরি মানুষ ঢাকা ছাড়বে তা নয়। এর বাইরেও বহু মানুষ ভেঙে ভেঙে পথ পাড়ি দেবে। পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকেও শেষ মুহূর্তে ঢাকা ছাড়ার নজির রয়েছে। তবে সেই বেহিসাবি খাতের হিসাব পাওয়া যায় না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, কয়েক লাখ মানুষ শেষ মুহূর্তে ভেঙে ভেঙে পিকআপ-ট্রাকেও বাড়ি যায়। এর কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। তবে এই সংখ্যাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

[সহযোগিতায় নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট প্রতিনিধি]