ঢাকা: ঘন কুয়াশার কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিন উড়োজাহাজ অবতরণে বিঘ্ন ঘটছে। শাহজালালে নামতে না পেরে সম্প্রতি পাঁচটি ফ্লাইট কলকাতা ও সিলেটে নেমেছে।

কুয়াশার কারণে দেরিতে ফ্লাইট ছাড়ায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। সময়মতো গন্তব্যে যেতে না পেরে কেউ কেউ কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করছেন।

 

এর মধ্যে যশোর ও সৈয়দপুরে ঘন কুয়াশায় বিমানবন্দরের দৃশ্যমানতা (ভিজিবিলিটি) কমে যাওয়ায় কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ফিরে এসেছে ঢাকায়।

 

অন্যদিকে আকাশে চক্কর দিতে বাড়তি জ্বালানি পোড়াচ্ছে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ। কুয়াশার কারণে হেলিকপ্টার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ফ্লাইটও অর্ধেকে নেমে এসেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে শীত আরো বাড়তে পারে। এতে কুয়াশাও বাড়বে। এ সময় উড়োজাহাজ ওঠানামায় সমস্যাও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিগগিরই তারা এ সমস্যার সমাধান করবে।

বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঘন কুয়াশার মধ্যেও রানওয়ের অবস্থান দেখা যাবে, এমন প্রযুক্তি শাহজালালে নেই। অনেক সময় ৮০০ মিটারের মধ্যে রানওয়ের অবস্থান কম দেখা গেলেও ফ্লাইট অবতরণ করা সম্ভব। তবে পাইলটরা এ ঝুঁকি নিতে চান না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো অত্যাধুনিক ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) ব্যবহার করলেও শাহজালালে এখনো পুরনো ব্যবস্থা রয়ে গেছে। আবার তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া অন্য বিমানবন্দরগুলোতে আইএলএসের ব্যবস্থাই নেই। তাই এই দুর্ভোগ কমাতে সব বিমানবন্দরে দ্রুত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, রানওয়েতে সাধারণত দৃশ্যমানতা ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার থাকলে উড়োজাহাজ ওঠানামা করে। সাধারণত তা তিন হাজার মিটার বা তার নিচে নামলেই আবহাওয়া অধিদপ্তর এভিয়েশন ওয়ার্নিং দেয়, সেটি দুই হাজার বা তার নিচে এলে তখন বিমান নামতেও পারে না। তখন পাইলটরা ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিংয়ের সহায়তা নেন। কিন্তু শাহজালালে আইএলএস ক্যাটাগরি-১ হওয়ায় ঘন কুয়াশার মধ্যে নামা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ অনেক দেশই বিমানবন্দরে আইএলএস ক্যাটাগরি-৩ ব্যবহার করছে। সে ক্ষেত্রে কুয়াশা থাকলেও নামতে সমস্যা হয় না। এ কারণে ঢাকায় সমস্যা হলে কিছু ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে নামছে।

বিমানবন্দরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সম্প্রতি ঘন কুয়াশার কারণে শাহজালালে অবতরণ করতে পারেনি বিমানের পাঁচটি ফ্লাইট। দীর্ঘক্ষণ ঢাকার আকাশে চক্কর মেরে একটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম ও তিনটি ভারতের কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকেই ঘন কুয়াশার কারণে বিমানবন্দরের ফ্লাইট ওঠানামা ব্যাহত হয়। আড়াই ঘণ্টা পর কুয়াশা কমায় সকাল ১০টায় ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে আসা সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের সাড়ে ৭টার ফ্লাইটটি প্রায় আড়াই ঘণ্টা আকাশে চক্কর মেরে সোয়া ১০টায় অবতরণ করে। এ ছাড়া সকালের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের দোহা ও শারজাহ থেকে ঢাকাগামী দুটি ফ্লাইট এবং আবুধাবি থেকে ঢাকাগামী এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইট দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে অবতরণে ব্যর্থ হওয়ায় সেগুলোকে কলকাতা বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। পরে ফ্লাইটগুলো সেখানে নিরাপদে অবতরণ করে। এ ছাড়া ইউএস-বাংলা, ভিস্তারা এয়ারলাইনস, গালফ এয়ারসহ বেশ কয়েকটি ফ্লাইট দেরিতে অবতরণ করেছে। একই কারণে ঢাকা থেকে ডজনখানেক ফ্লাইট উড্ডয়ন করতে পারেনি।

শুধু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নয়, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়েছেন। সম্প্রতি সৈয়দপুরে নামতে না পেরে দুটি ফ্লাইট ফিরে আসে শাহজালালে। ভোর ৪টার পর থেকে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ের দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় প্রায় প্রতিদিন তিনথেকে পাঁচ ঘণ্টা ফ্লাইট উড্ডয়নে দেরি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও নভো এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর শীতকালে এই সমস্যা হয়। যশোর ও সৈয়দপুরে আমাদের সমস্যা হয়। আমাদের এখানে ল্যান্ডিংয়ের জন্য ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবস্থা কিছুটা থাকলেও ঢাকার বাইরে কিছুই নেই। আদিকালের প্রযুক্তি নিয়ে আমরা এখনো আছি। শাহজালালে আইএলএস ক্যাটাগরি-১ ব্যবহূত হচ্ছে। এর চেয়ে আরো উন্নত ক্যাটাগরি-২ ও ৩ অনেক দেশ ব্যবহার করছে। আমরা বহু বছর ধরে ক্যাটাগরি-১ নিয়ে বসে আছি। কুয়াশা হলেই আকাশে দেড়-দুই ঘণ্টা চক্কর দিতে তেল পোড়ে, যাত্রীরা বিরক্ত হন। আমাদের ক্যাটাগরি উন্নয়ন করতে হবে।’

গতকাল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়াশার কারণে একটি ফ্লাইটের যখন দেরি হয়ে যায়, তখন শুধু ওই ফ্লাইটের যাত্রী নন, ফিরতি ফ্লাইটের যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়েন। টাওয়ার অনুমতি না দিলে ফ্লাইট নামতে পারে না। প্রতিদিন সকালে সাত-আটটি করে ফ্লাইট ডাইভার্ট হচ্ছে। ইদানীং সিলেট, কলকাতায় গিয়েও নামতে হচ্ছে। এতে আমাদের তেল খরচ, ল্যান্ডিং চার্জসহ অপারেশন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আবার আমরা শিডিউল যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারছি না। কলকাতায় আমাদের সমস্যা নেই। আমরা এখনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছি না। আশা করি, এই সমস্যার সমাধান হবে। ’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের শীর্ষস্থানীয় হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের একজন ক্যাপ্টেন বলেন, ‘কুয়াশার কারণে সকাল ১১টার আগে আমরা হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করতে পারছি না। আবার বিকেলের আগেই চলে আসতে হচ্ছে। এতে হেলিকপ্টার ফ্লাইট প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। ’ আগে মাসে প্রায় ৩৫০টি ফ্লাইট চলত বলে তিনি জানান।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়াশা বাড়ছে, তাই রানওয়ের ভিজিবিলিটি কমে আসছে। বিমানবন্দরে পুওর ল্যান্ডিং ভিজিবিলিটির জন্য যে প্রযুক্তি দরকার, তা আমাদের নেই। আমাদের যে আইএলএস আছে, ৬০০ মিটার পর্যন্ত এর ভিজিবিলিটি থাকলে ফ্লাইট নামতে পারে। তা-ও এটি শুধু ঢাকা ও সিলেটে আছে, চট্টগ্রামে থাকলেও এখনো চালু হয়নি। বাকি বিমানবন্দরগুলোতে এই সুবিধা নেই। ফলে এসব বিমানবন্দরে রানওয়ে দেখতে না পারলে তখন চলে আসতে হয়। আমাদের আইএলএস ক্যাটাগরি-১। ক্যাটাগরি-৩ সবচেয়ে ভালো। আমাদের আইএলএস উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্রেস লাইটিংয়ের উন্নয়ন করতে হবে। অনেক বছর থেকে কথা হচ্ছে, কিন্তু এটা হালনাগাদ হচ্ছে না। যেহেতু দেরি হয়েছে, তাই একবারে ক্যাটাগরি-৩ এ উন্নীত করতে হবে। ’

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বলেন, সকালে কুয়াশার কারণে যেসব ফ্লাইট ঢাকায় নামতে পারেনি, সেগুলো সিলেট, চট্টগ্রাম ও কলকাতায় ডাইভার্ট হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুয়াশা কমে এলে বিমানবন্দরের ফ্লাইট ওঠানামা স্বাভাবিক হয়ে আসে।

তিনি বলেন, ‘কুয়শার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে আমরা জনবল বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর অনেকগুলো ফ্লাইট একই সময় অবতরণের পর দ্রুত অভিবাসন ও অন্যান্য কাজ করা যায়। ’

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান গতকাল বলেন, ‘কুয়াশার কারণে ভিজিবিলিটি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আমরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আইএলএস ক্যাটাগরি-১ থেকে ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করতে যাচ্ছি। এটি করতে আমাদের রানওয়ের সেন্ট্রাল লাইনে লাইটিং সিস্টেম ও ইলেকট্রিক সিস্টেমে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। এটি করতে আমাদের রানওয়ে বন্ধ রাখতে হবে। আশা করছি, জানুয়ারি মাস থেকে আমরা এই কাজ শুরু করতে পারব। ’

এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘আইএলএস ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত হলে ২০০ মিটার ভিজিবিলিটিতেও উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারবে। তবে জিরো ভিজিবিলিটিতে উড়োজাহাজ নামতে পারবে না। এ জন্য আমাদের ক্যাটাগরি-৩-এ উন্নীত করার প্রয়োজন হবে। ’