ঢাকা: যশোরে দলের জনসভা থেকে নৌকায় ভোট দেওয়ার ওয়াদা চাইলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আবারও দেশবাসীর প্রতি আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি অভয় দেন এই বলে, ‘রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই। ব্যাংকে টাকা নেই—এ কথা মিথ্যা।

 

কেউ গুজবে কান দেবেন না। ’ প্রধানমন্ত্রী ড্রেজিং করে ‘যশোরের দুঃখ’ ভবদহ নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।

 

গতকাল বিকেলে যশোর শামস-উল হুদা স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নির্বাচনী জনসভা শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনসভাটি বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সমাবেশস্থল ছাড়াও আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল নামে। জনসভায় আধাঘণ্টার কিছু বেশি সময় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি খুন করা, নির্যাতন করা, অত্যাচার করা, জেল-জুলুম আর মামলা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই যে আগামী নির্বাচনেও আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। হাত তুলে সে ওয়াদা করেন। ’ প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে উপস্থিত নেতাকর্মীরা দুই হাত তুলে সম্মতি জানান।

জনসভায় সভাপতিত্ব করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, পীযূষ ভট্টাচার্য, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র ও সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন প্রমুখ।

ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই। অনেকে ব্যাংকের টাকা নিয়ে কথা বলে। ব্যাংকে টাকা নেই—এ কথা মিথ্যা। আমাদের এ বিষয়ে (ব্যাংকের টাকা) কোনো সমস্যা নেই। প্রতিটি ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে। আমাদের রেমিট্যান্স ও বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। রপ্তানি আয় ও ট্যাক্স কালেকশন বেড়েছে। বিশ্বের অন্য দেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। ’

গুজবে কান দেবেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির কাজই হচ্ছে সব সময় গুজব ছড়ানো। ওরা নিজেরা কিছু করতে পারে না। ক্ষমতায় যখনই এসেছে, লুটপাট করে খেয়েছে। ১৯৯৬ সালে আমি যখন সরকার গঠন করি, তার আগে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা রিজার্ভ রেখে গিয়েছিল ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করলাম, তখন রিজার্ভ ছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এখান থেকে আমরা ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে রিজার্ভ তুলেছিলাম। সেখান থেকে ভ্যাকসিন কেনা, সার কেনা, চাল, ভুট্টা, গম নিয়ে আসা, যত জিনিস আনা দরকার, আমরা জনগণের জন্য দুই হাতে নিয়ে এসেছি। রিজার্ভ অন্য কোথাও যায়নি, জনগণের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। এখন রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ নির্মাণ করতে আট বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছি। ’

তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। এখন আমরা দ্বিতীয় আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যার ফলে যশোর, খুলনার এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকার জলাবদ্ধতার নিরসন হবে। আমরা ৮২ কিলোমিটার নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ভবদহ নদীর কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সমস্যা আছে। আমরা সেসব এলাকায় ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা যাতে ফিরে পায় সে জন্য ব্যবস্থা করে দেব। ’

আমরা চিফ জুডিশিয়াল আদালত ভবন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করে দিয়েছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যশোরে দারিদ্র্য বিমোচন ট্রেনিংয়ের জন্য জহিরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমি করে দিচ্ছি। এর জন্য ৫০ একর জমি নেওয়া হয়েছে। ’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে স্টেডিয়ামে আমরা মিটিং করে গেলাম, সেটা জরাজীর্ণ। এটাকে আরো উন্নত করে দেব। এই গ্যালারি ভেঙে নতুন আধুনিক ১১ স্তর বিশিষ্ট গ্যালারি করে দেব। ’

করোনার কারণে বাইরে এত দিন জনসভা করতে পারিনি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'আজকে আমার প্রথম জনসভা এই যশোরে। এই যশোরে আমার নানা শুয়ে আছেন। এই যশোর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে যশোর খেজুর গুড়ের যশোর, ফুলের যশোর, উন্নয়নের একটা দৃষ্টান্ত, সেই যশোরে আসতে পেরে আমি আনন্দিত।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। এই বাংলাদেশে একটি মানুষ না খেয়ে থাকবে না, একটি মানুষ গৃহহীন থাকবে না, একটি মানুষও ধুঁকে ধুঁকে মরবে না। '

যশোরে জনসভায় বিপুল লোকসমাগমের কারণে অনেকেই মাঠে প্রবেশ করতে পারেনি। বিপুল সংখ্যায় মাইক এবং ১০টি স্থানে বড় পর্দায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে ও দেখতে পারার ব্যবস্থা করায় জনসভাস্থলের আশপাশের রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য।

জনসভায় আসা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিপুল সংখ্যায় মানুষ এসেছে যশোরের কেশবপুর, বেনাপোল, শার্শা, ঝিনাইদহ ও নাভারণ, নড়াইল ও মাগুরা থেকে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকেও মানুষ এসেছে। বাস, ট্রাক ছাড়াও বিশেষ ট্রেনে মানুষ আসে খুলনা ও বেনাপোল থেকে।

দুপুর আড়াইটার সময় মুজিব সড়কে কথা হয় আবু বকর সিদ্দিকের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেই সক্কালে আঁধার থাকতি বাড়ি থেকে বাইরোছি; এখন রোদে পুড়ে যাচ্ছি। মাঠের মধ্যি ঢুকতি পারিনি। ’

আবু বকর সিদ্দিকের মতো দূর-দূরান্তের মানুষ ভোরবেলায় রওনা হয়। বেনাপোল থেকে এসেছেন উসমাত মোড়ল (৬৭)। অনেকের সঙ্গে ট্রাকে করে এসে চাঁচড়ার মোড়ে নামেন। সেখান থেকে হেঁটে সকালে জনসভাস্থল, প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের শামসুল হুদা স্টেডিয়ামে পৌঁছেন। প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন, তিনি ভাষণ দেবেন, শুনতে এসেছি। ’

উপজেলা, জেলা থেকে মানুষ এসে নগরীর মধ্যে মিছিল নিয়ে স্টেডিয়ামমুখো হয়। মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় যশোর। মিছিলকারীদের হাতে পতাকা, কারো কারো মাথায় দলের, নেতাদের নামাঙ্কিত ফেস্টুন বাঁধা ছিল।    

যশোরের দড়াটানা মোড়ে দাঁড়িয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মধ্যবয়সী আব্দুল হামিদ। মিনিট ১৫ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি বলেন, ‘অনেক মিছিল, ম্যালা মানুষ। যশোরে আজ মানুষ ভাইঙ্গে পড়িছে। ’ এরই মধ্যে দেখা যায়, ঝিকরগাছার এক যুবককে, যাঁর শরীরের উপরিভাগ জাতীয় পতাকার আদলে লাল-সবুজের রঙে আঁকা। মাথায় নৌকা। তাতেও লাল-সবুজের রঙের প্রলেপ।

আওয়ামী লীগ যশোর জেলা শাখার সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। যশোরের জনসভায় মানুষ উপচে পড়েছে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে। ’