আবারও ফিরে এসেছে সেই উত্তাল মার্চ। বাংলাদেশের জন্ম ও এ দেশের মানুষের আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় মাস। এই মাসেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ মাসের শুরু থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
এ মাসের প্রায় প্রতিটি দিন ঐতিহাসিক ঘটনায় উজ্জ্বল। ২ মার্চ তেমনি একটি দিন।
১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশে সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) ভিপি ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব।
অন্য ছাত্রনেতারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রসমাবেশ থেকে পরদিন পল্টন ময়দানে জনসমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। সভা শেষে বিশাল এক শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররমের দিকে যাত্রা করে। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়ানো হয়।
সেই থেকে ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ওই পতাকা তৈরি সম্পর্কে সিরাজুল আলম খান তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘ছোট পরিসরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের দিন অর্থাৎ ২ মার্চের সভায় বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। আ স ম আবদুর রবকে ডেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হলো। কথাটা শোনার পর তাঁকে খুবই উত্তেজিত দেখলাম। সে উত্তেজনা কেবল নতুন একটি পতাকা উত্তোলনের আবেগ থেকে নয়, তার চেয়েও বড় কিছু করার প্রত্যয় যেন তাঁর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে।
যথারীতি ২ মার্চ কলা ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়।...এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পটুয়া কামরুল হাসানের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়।
৫৪ বছর আগের এই দিনটি সম্পর্কে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হরতালের দিনে ফাঁকা রাস্তার মাঝখান দিয়ে...হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের দিকে চলে গেলাম।
কি আশ্চর্য! আজকে কাঁচাবাজারও বসেনি। চিরকাল দেখে আসছি হরতাল হলেও কাঁচাবাজারটা অন্তত বসে। আজ তা-ও বসেনি। সব ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সর্বত্র যানবাহন, হাটবাজার, অফিস-আদালত ও কলকারখানায় পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে, সবাই সেটা মনে-প্রাণে মেনে নিয়েই আজ হরতাল করছে।
ওই দিন রাতে হঠাৎ বেতার মারফত ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। উত্তেজিত জনতার কণ্ঠে ভয়াল গর্জন ওঠে ‘সান্ধ্য আইন মানি না, মানব না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’—এসব স্লোগান। শহরজুড়ে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়।