ঢাকা: বর্তমান পৃথিবীতে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টানিষেধাজ্ঞা, কভিড মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জের প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি বৈশ্বিক সংকটগুলো মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগের আহবান জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলনে ‘এক বিশ্ব’ শীর্ষক প্রথম অধিবেশনে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহবান জানান। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকটের কথা ভুলে না যাওয়ারও আহবান জানান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ জি২০ সদস্য ও আমন্ত্রিত দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই আফ্রিকান ইউনিয়ন জি২০ ফোরামের স্থায়ী সদস্য হিসেবে যোগ দেয়।
এর আগে নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির প্রগতি ময়দানে ভারত মণ্ডপ কনভেনশন সেন্টারে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রগতি ময়দানের ভারত মণ্ডপ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্রে তাঁরা একে অপরের প্রতি শুভেচ্ছা জানান। শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় জো বাইডেন তাঁর নিজের মোবাইল ফোনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফি তোলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের থিম্যাটিক অ্যাম্বাসাডর এবং অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ টুইটারে লিখেছেন, ‘নয়াদিল্লিতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে জো বাইডেনের সঙ্গে চমৎকার খোশগল্প হয়েছে। আমি তাঁকে সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে মনোবিজ্ঞানী রাখার গুরুত্বের কথা বলেছি।’
সায়মা ওয়াজেদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তোলা বেশ কয়েকটি ছবি আপলোড করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকেও ছবিগুলোতে দেখা যায়। একটি ছবিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে সেলফি তুলতেও দেখা যায়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি আয়োজিত নৈশ ভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনাসহ অন্য নেতারা। নৈশ ভোজ অনুষ্ঠানেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কুশল বিনিময় করেন।
এর আগে গতকাল সকালে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘এক পৃথিবী’ বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নের ওপর জোর দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘এক পৃথিবী’র আলোকে ভারতের লাইফ মিশন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ এবং ‘গ্রিন গ্রিডস’ উদ্যোগের ওপর জোর দেন। ‘এক সূর্য, এক বিশ্ব, এক গ্রিড’ ভাবনার ভিত্তিতে তিনি সৌর বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক কৃষি ও জাতীয় গ্রিন হাইড্রোজেশন মিশনের কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার এবং বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর চার দফা সুপারিশে এই আহবান জানান। শীর্ষ সম্মেলনে ‘এক পৃথিবী’ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি তাঁর সুপারিশের প্রথম দফায় বলেছেন, ‘এখানে জি২০ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ কার্যকর সুপারিশ তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।’
শেখ হাসিনা তাঁর সুপারিশের দ্বিতীয় দফায় বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এবং সারা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত।
তৃতীয়ত, ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের’ ত্রয়ী দেশের সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ‘জলবায়ুজনিত অভিবাসন মোকাবেলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালুর জন্য সবাইকে অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার কথা বৈশ্বিক সম্প্রদায় ভুলবে না এবং তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে ও শক্তিশালীকরণে জি২০ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নেওয়া উন্নয়নমূলক বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন। তিনি সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনেও বক্তব্য দেন। ‘এক পরিবার’ শীর্ষক ওই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী সবার সমৃদ্ধির জন্য বিশ্বনেতাদের আন্তরিকভাবে কাজ করার ওপর জোর দেন। তিনি এ সময় পাঁচ দফা সুপারিশ করেন।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী গতকাল তাঁর বক্তব্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসেবে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টানিষেধাজ্ঞা, জলবায়ু পরিবর্তন রোহিঙ্গা সংকটসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন।
বৈশ্বিক জৈব জ্বালানি জোটে বাংলাদেশ
জি২০ সম্মেলনের প্রথম দিন বাংলাদেশ বৈশ্বিক জৈব জ্বালানি জোটে যোগ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ৯টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা মিলে এই জোটের সূচনা করেন।
জি২০ সভাপতি হিসেবে ভারতের অন্যতম অগ্রাধিকার বৈশ্বিক জৈব জ্বালানি জোট। এই জোটে যোগ দেওয়ার ফলে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় জৈব জ্বালানি উৎপাদক ব্রাজিল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো আগ্রহী দেশগুলো কাজ করবে। জৈব জ্বালানির ব্যবহার জোরদার ও সহযোগিতা আরো সহজ করাই এ জোটের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে তিন দিনের সফরে গত শুক্রবার দুপুরে নয়াদিল্লি পৌঁছান। আজ রবিবার সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর বিকেলে তাঁর ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।