মোনায়েম সরকার

বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ৭৩ বছরে পদার্পণ করেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এত বছরের দীর্ঘ পথ চলা নিঃসন্দেহে গৌরবজনক  ঘটনা। আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬দফাও ৫৬ বছর অতিক্রম করেছে। যেই ৬দফার পথ বেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে, সেই ৬দফা যে সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছিল, তাও আজ প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে অনন্য বিস্ময়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ৬দফার ঘোষণাই রচনা করেছে আধুনিক বাংলাদেশের সুদৃঢ় ভিত্তি। তাই ইতিহাসের নিরিখে বলাই যায় আওয়ামী লীগ, ৬দফা ও  স্বাধীন বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত দাবি। আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিজ নিজ অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়। পাশ্চাত্যে এসচেতনতার বিকাশ ঘটেছিল রেনেসাঁর অনুষঙ্গ হিসেবে। ভারতবর্ষে আধুনিক মানসিকতার স্বাধিকারের চেতনা প্রথম পরিলক্ষিত হয় উনিশ শতকের আশির দশকে এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠন এর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ন। জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল ভারতের ধর্মবর্ণভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষকে একত্রিত করা। বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাও ছিল এর পরিপূরক। কিন্তু বিশের দশকের অসহযোগখেলাফত আন্দোলনের পর ইংরেজদের কুটচক্রান্ত ডিভাড এন্ড রুল পলিসি হিন্দুমুসলমানদের মধ্যে প্রথম অবিশ্বাস ও পরে দাঙ্গা শুরু হলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিভক্ত হয়ে পড়ে। চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানরা পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করে যার একটি রূপ প্রতিফলিত হয়েছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে।

অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক লাহোরের মুসলিম লীগ সম্মেলনে যেপ্রস্তাব উত্থাপন করেন তাতে ভারতবর্ষের পূর্বে ও উত্তরপশ্চিমে মুসলমানদের জন্য দুটো পৃথক স্বাধীন দেশ (states)এর দাবি ছিল। যদিও চৌধুরী রহমত আলী এবং আল্লামা ইকবালের PAKISTAN সম্পর্কিত মূল চিন্তা ধারায় বাংলার কোন স্থান ছিল না। ওটি ছিল মূলত পাঞ্জাব (P), আফগানিস্তানের (A), কাশ্মীর (K), ইন্দাজ (সিন্ধু) (I) ও বেলুচিস্থান (stan) কেন্দ্রিক। কিন্তু জিন্নাহ ও লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ চক্র কয়েক বছরের মধ্যেই ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে মুসলমানদের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণাকে নস্যাৎ করে দেয়। ইতোমধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু, হিন্দু মহাসভার সা¤প্রদায়িক প্রচার এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কট্টর অবস্থান বাংলার হিন্দুমুসলমান রাজনৈতিক সম্পর্ক তিক্ততার চরমে নিয়ে যায়। ফলে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার মুসলমানরা মুসলিম লীগের প্রভাবে পাকিস্তানের পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানায়। যদিও পশ্চিম পাকিস্তান সমর্থিত প্রদেশসমূহের একটিতেও মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।

১৯৪৭ সালের মধ্যআগস্টে ভারত ও পাকিস্তান গঠিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতার আনন্দে উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বুঝতে পারে যে, প্রকৃত স্বাধীনতা তারা পায়নি। বাঙালির সহজাত প্রতিবাদের ধারা গড়ে উঠতেও দেরি হয়নি। এর প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮এর মার্চে ভাষার দাবিতে প্রতিবাদবিক্ষোভ যার চূড়ান্ত পরিণতি বায়ান্নর রক্তঝরা ভাষাআন্দোলন। পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় মুসলিম লীগের প্রতি চরম অনাস্থার প্রকাশ। কিন্তু পাকিস্তানকে বিদায় জানানোর প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানের মন তখনও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ১৯৫৪৫৮ পর্বে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের একাধিক প্রয়াস ও সুযোগ সামরিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রের মুখে    বাস্তবায়িত হতে পারেনি। এ সময়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে পাকিস্তানের শাসনে অংশীদারিত্ব না দিতে তারা বদ্ধপরিকর।    

পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ ১৯৪৯ সালেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা নিয়ে মুসলিম অভিধা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ভাষা আন্দোলনের বিপুল উৎসাহে ত্রিশের দশকের ধর্মভিত্তিক চিন্তাকে পরিত্যাগ করে পুনরায় ভাষাভিত্তিক অসা¤প্রদায়িক মঞ্চে সমবেত হয় পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৫৬৫৭ সালে অল্প সময়ের জন্য পাকিস্তান সরকারের কতৃর্ত্ব লাভেও তারা সমর্থ হয়। কিন্তু নেতৃত্বের একাংশের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য বাঙালির রাজনীতির মূল ে¯্রাতে আবার ভাঙন ডেকে নিয়ে আসে।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ বিভক্তি এরই পরিণতি। এ সম্মেলনে মওলানা ভাসানী  পাকিস্তানকে বিদায়ী সালাম জানান। পরবতীর্তে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা অংশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেমন খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখকে নিয়ে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাপের জন্ম হয়। কিন্তু ন্যাপের পরবতীর্ কার্যক্রমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সমাজতন্ত্রের দাবির কাছে গৌণ হয়ে যায়। ফলে ন্যাপ রাজনীতি মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন সমগ্র পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, নির্যাতন, নিষেধাজ্ঞা জারী এবং অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের দিয়ে কনভেনশনে মুসলিম লীগ তৈরি করে তিনি এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। এর বিরুদ্ধে প্রথম বিস্ফোরণ দেখা যায় ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজদেরকে পুনরায় সংগঠিত করতে শুরু করে।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম পর্বে আওয়ামী লীগের মূল নেতা ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর্, আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান, জহির উদ্দিন, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় পর্বে সোহরাওয়াদীর্র পরেই শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের মূল সংগঠকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়াদীর্র মৃতুর পর আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতাদের বিরোধিতার মুখেও আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে শেখ মুজিবুর রহমানই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ সময়ের মূল প্রয়াস ছিল পাকিস্তানের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ সম্মিলিত বিরোধী দল বা কপ (পড়ঢ়)এর প্রার্থী হন এবং তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পরাজিত হন।

ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে লাহোরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। আওয়ামী লীগ উক্ত সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে প্রথম দিকে মনস্থির করতে পারেনি। অবশেষে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ দশ সদস্যের আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল এতে যোগদান করেন। অন্যান্য দল থেকে ১১ জন প্রতিনিধি ঢাকা থেকে যান, তবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০এর অধিক সদস্য উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত সম্মেলন ১০ ফেব্রুয়ারি ৬দফা উত্থাপন করে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকসাংস্কৃতিক স্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন।

লাহোরের সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রাথমিকভাবে যে ৬দফা উত্থাপন করেন তা ছিল সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব আকারে :

১.   শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিষ্ঠা যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ;

২.   ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অবশিষ্ট বিষয়গুলি ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে থাকবে;

৩.   দুটি পরস্পর বিনিময়যোগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ একটি মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহ রোধের শাসনতান্ত্রিক বিধান। ফেডারেশনের ইউনিটগুলির জন্য পৃথক রাজস্ব ও অর্থনীতি থাকবে;

৪.   করারোপ ও লেভি বলবৎ করার বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে থাকবে, কেন্দ্রের হাতে নয়, কেন্দ্রে যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় তহবিলের জন্য প্রদেশগুলির কাছ থেকে সকল কর রাজস্বের একটা অংশ পায় তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে;

৫.   প্রতিটি প্রদেশের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি করে পৃথক হিসাব খোলা হবে এবং তারা প্রত্যেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তার ওপর তাদের নিজ নিজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আর এর একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির আন্তঃপ্রদেশ চলাচল ও পরিবহণের বেলায় অভিশুল্কমুক্ত সুযোগসুবিধে থাকতে হবে। প্রদেশগুলির বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানোর এবং সংশি­ষ্ট প্রদেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকতে হবে;

৬.   প্রদেশগুলির জন্য আধাসামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকতে হবে।

দফায় কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় থাকবে, একমাত্র স্টেটসমূহের হাতে কর ধার্যের ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়, করের একটা নির্ধারিত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় তহবিল গঠিত হওয়ার কথা বলা হয়, আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্র অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কতৃর্ত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। শেখ মুজিব কতৃর্ক উত্থাপিত ৬দফা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকল এবং পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য দলের কোনো নেতাই সমর্থন করেনি।

সম্মেলনের আয়োজকগণ শেখ মুজিবুর রহমান কতৃর্ক উত্থাপিত ৬ দফা নিয়ে কোনো প্রচার বা আলোচনা সম্মেলনে করতে রাজি হননি। ফলে শেখ মুজিব এবং তাঁর প্রতিনিধি দল উক্ত সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন।

চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এম এ আজিজ, আবদুল্ল¬াহ আল্ হারুন এবং এম এ হান্নান ৬দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম বিবৃতি প্রদান করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করলে ৬দফা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ৬দফার পক্ষে এবং বিপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান, এমনকি আওয়ামী লীগেও দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬দফার কড়া সমালোচনা করে বিবৃতি প্রদান করে। জামাতে ইসলাম এবং নেজামে ইসলামও ৬দফার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করে। ঐদিন শেখ মুজিব পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ৬দফার বিষয়বস্তুর উপর বিশদ ব্যাখ্যা দেন।

বস্তুত আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে যে চিন্তাভাবনা ও আন্দোলনের সূচনা করেছিলো যা শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৬দফা দাবির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠলো। শেখ মুজিব এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবিভূর্ত হলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতা হিসেবে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই সময় আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠলো। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শেখ মুজিবের ৬দফার সামগ্রিক প্রস্তাবনা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন লাভ করে। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬দফা আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ও দাবিতে পরিণত হয়।

আওয়ামী লীগ ৬দফা গ্রহণ করার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় শেখ মুজিব দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এই জনসভার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব ৬দফার পক্ষে জনমত সংগঠন শুরু করেন।

১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার ইডেন হোটেলে। কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬দফাকে দলের প্রধান মেনিফেস্টো হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকেই আওয়ামী লীগ দলের প্রধান নীতি বলে বিবেচনা করে।

আওয়ামী লীগের নতুন কাউন্সিল অধিবেশন এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন ৬দফার সংগ্রামকে বেগবান করার উদ্দেশ্যেই হয়েছিল। ইতোমধ্যে ৬দফাকে জনগণের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রথম একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনের আগে তাজউদ্দিন আহমদের লিখিত একটি সারগর্ভ ভূমিকাসহ উক্ত পুস্তিকার নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে ৬দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ৬দফার ব্যাখ্যাসহ আমাদের বাঁচার দাবী ৬দফা শিরোনামে তৃতীয় এবং নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এটি প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিন কর্তৃক পূর্ব  পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ৫১ পুরানা পল্টন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল। ৬দফার  বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ এটি জনগণ, সরকারসহ সকল স্তরে দ্রুত পেঁৗছাতে থাকে। পাকিস্তান সরকার ৬দফাকে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি স্বরূপ গ্রহণ করে। আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬দফার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে থাকেন। তেমনিভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সরকারের এসব অপব্যাখ্যার আচরণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন।

১৯৬৬ সালের ১০ মের মধ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ৩ হাজার ৫০০ জন নেতাকমীর্ গ্রেপ্তার হয়ে যান। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিব তার আগেই সবকিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে কমীর্ বাহিনী যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তার সংগঠনকে। এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যেও ৬দফার বিরুদ্ধে একটি ে¯্রাত ক্রিয়াশীল ছিলো। শেখ মুজিব ৬দফার পক্ষের জেলা পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতাদেরও সংগঠিত করেছিলেন, যাতে করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৬দফাপন্থী আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা ছাত্রলীগের সহায়তায় আবার সংগঠিত হতে শুরু করেন।

ছাত্রলীগের এ সময়কালের সভাপতি মাযহারুল হক বাকি ছিলেন অনেকটা শান্ত স্বভাবের। ৬দফার পক্ষে তার চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। তবে মাযহারুল হক বাকি ৬দফার বিরোধী পক্ষকেও আমল দেননি। সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের সাথে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের গভীর সম্পর্ক ছিলো। ছাত্র ইউনিয়নের সহায়তায় আবদুর রাজ্জাক ৬দফার ৫০ হাজার লিফলেট ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে বিলি করেছিলেন। কমিউনিস্ট এবং ন্যাপের যে অংশ (মস্কোপন্থী বলে খ্যাত) ৬দফার সমর্থক ছিলেন তারা দৈনিক সংবাদ থেকে ৬দফার লিফলেট ছাপিয়ে দিতেন। পক্ষান্তরে চীনপন্থী কমিউনিস্ট ও ন্যাপ ৬দফাকে সি.আই.এর দলিল বলে প্রত্যাখান করে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পল্টন ময়দানে একটি জনসভা ডাকা হয়েছিলো ১৯৬৬ সালের ১৩ মে। ছাত্রলীগের উদ্যোগই ছিলো বেশি। শেখ মুজিব জেলে থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে নির্দেশ পাঠান জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ৬দফার পক্ষে হারতালমিছিল ও জনসভার কর্মসূচি নেবার জন্য। মাযহারুল হক বাকি, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া, শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান ও ছাত্রলীগ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করেন। গ্রেপ্তারের হুমকির মুখেও ৬দফাসহ বন্দি নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে প্রচার চালাতে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যারা ভেতরে ভেতরে ৬দফা পছন্দ করতেন না, তারা তখন দ্বিতীয় দফার গ্রেপ্তার এড়াতে ব্যস্ত। গভর্নর মোনেম খান বুঝতে পারেন নি যে এরপরও আওয়ামী লীগ নড়েচড়ে উঠবে। তাই তার নির্দেশে আরেক দফা গ্রেপ্তার শুরু হলো। কিন্তু সবাই আগে থেকেই ছিলেন সতর্ক। এবারকার গ্রেপ্তার অভিযানে পুলিশ খুব সুবিধা করতে পারে নি। ৭ জুন, ১৯৬৬ তারিখে হরতালের পক্ষে লিফলেট ছাপিয়ে মহল্লায় মহল্লায় শুরু হয় প্রচার অভিযান। নারায়ণগঞ্জেও একই অবস্থা। ৬ জুন নবাবপুর রেল ক্রসিংএর কাছে আওয়ামী লীগের মশাল মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। কিন্তু দেখা গেলো ৬ জুন রাত বারোটা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল হচ্ছে। হরতাল প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েও সরকার ব্যর্থ হলো।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন সকাল থেকেই হরতাল শুরু হলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে। সকাল নয়টার দিকে তেজগাঁ শ্রমিক এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে বেঙ্গল বেভারেজে চাকরিরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যান। মনু মিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শ্রমিকসমাজ। তাদের সাথে যোগ দেয় ছাত্রজনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে মিছিলসমাবেশ সংগঠিত হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও গুলি চালায়। এক পর্যায়ে পুলিশ কার্জন হলের ভেতরে ঢুকে পরে।

টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচতে আমি দুই তলা থেকে নিজতলায় একটি এসি কামরায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করি। তখন পুলিশের সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়। আমার বাম হাতের তিন প্রধান আর্টারি কেটে যায়। ঢাকা মেডিকেলে ডা. আলমের অপারেশনে আমি বেঁচে যাই। সেই দাগ এখন আমার বাম হাতের কব্জিতে রয়েছে। পাসপোর্ট বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে এই স্থায়ী পরিচিতি চিহ্ন আমি আজো ব্যবহার করি।

হাসপাতালে আমার বিছানার পাশে ফরিদপুরের ২ জন গামছা ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ জুনে আহত সকল নেতাকমীর্দের পুলিশ হাসপাতালে স্থানান্তর করার খবর পেয়ে আমাদের দলীয় ডাক্তারদের পরামর্শে আমাকে ডিসচার্জ করা হয়। ৭ দিন পর সেলাই খুলতে হাসপাতালে গিয়ে দেখলামÑ সবাইকে পুলিশ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেই সময়কার চরম নির্যাতনের নমুনা তুলে ধরতে এ বিষয়টি উল্লেখ করলাম।

শ্রমিকজনতা তেজগাঁয় স্টেশনে সকল ট্রেন থামিয়ে দেয়। তেজগাঁ স্টেশনের কাছে নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হোসেন (আজাদ এনামেল অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম কারখানা) ইপিআরএর রাইফেলের সামনে বুক পেতে দেন। ইপিআর বাহিনী তার বুকেও গুলি চালায়। অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত এলাকার শ্রমিক এবং আওয়ামী লীগছাত্রলীগের কমীর্রা ঢাকা শহর উত্তাল করে তোলে। নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বিক্ষোভপ্রতিবাদে সর্বস্তরের শত শত মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের উস্কানির মুখে জনগণ থানার মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো তাদের ছিনিয়ে নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পরপরই ঢাকার শ্রমিক এলাকাগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। গ্রেপ্তারের সংখ্যাও সন্ধ্যার মধ্যে দেড় হাজার ছাড়িয়ে যায়।

এরপরের ইতিহাস জেল, জুলুম, হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টার ইতিহাস যার চূড়ান্ত রূপ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু ৬৯এর অভূতপূর্ব গণআন্দোলন সকল অপচেষ্টাকে নসাৎ করে দেয়। গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে আইয়ুব শাহীর এবং শেখ মুজিবুর রহমান রূপান্তরিত হন বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুতে। আর মাত্র দুবছরের মধ্যে ৬দফা রূপান্তরিত হয় এক দফায়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৬দফা ও ১১দফার সমর্থনে বাঙালি বাংলাদেশের পক্ষে গণরায় ঘোষণা করে। ৬দফার লড়াই পর্যায়ক্রমে ডাক (Democratic Action Committee), ১১দফা, গণঅভ্যুত্থান ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ১দফায় রূপান্তরিত হয়। ৬দফার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে এবং বঙ্গবন্ধুকেও নেতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তরে পেঁৗছে দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হবে এটাই আশা করে বাংলাদেশের মানুষ।

 

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।